আরব বসন্তের উত্সভূমিতে গণতন্ত্রের নূতন পরীক্ষা শুরু হইতে চলিয়াছে। টিউনিসিয়ায় নূতন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হইয়াছেন বেজি এসেবসি। উত্তর আফ্রিকার এই দেশটিতেই ২০১১ সালে আরব বসন্তের সূত্রপাত হয়। কুড়ি বছর ধরিয়া স্বৈরশাসন চালানো একনায়ক জিনে আল আবেদিন বেন-আলি প্রবল গণ-আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত ও দেশ হইতে বিতাড়িত হন। নির্বাচনে তাঁহার স্থলাভিষিক্ত হয় এন্নাহ্দা নামক ইসলামপন্থীদের দল এবং প্রেসিডেন্ট হন এন্নাহ্দারই মনোনীত মুনসেফ মারজুকি। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশে নূতন করিয়া পার্লামেন্ট নির্বাচন সম্ভাবিত করিলে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিক বলিয়া গণ্য বেজি এসেবসি-র দল তাহাতে গরিষ্ঠতা পায়। অতঃপর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও এসেবসি তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী মারজুকিকে পরাস্ত করেন। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়া আরব বসন্তের ঝোড়ো হাওয়ায় টালমাটাল মুসলিম রাষ্ট্রগুলির মধ্যে একমাত্র টিউনিসিয়াই গণতন্ত্রের পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ।
এই ফলাফলে সকল টিউনিসীয়ই খুশি, এমন নহে। এসেবসির জয়ের সংবাদে হতাশ ও ক্ষুব্ধ দক্ষিণের শহর হাম্মায় যুবকরা রাস্তায় নামিয়া অসন্তোষ জ্ঞাপন, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। বিরুদ্ধবাদীদের বক্তব্য: ৮৮ বছর বয়স্ক এসেবসি বিতাড়িত একনায়ক আবেদিন-এর ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁহার সরকারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও সামলাইতেন। এমন এক জনকে দেশের নবীন গণতন্ত্রে অভিষেক করা অনুচিত। প্রসঙ্গত অনেকেরই মিশরের দৃষ্টান্ত মনে পড়িবে। সেখানে ইতিহাসের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম ব্রাদারহুড দলের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুর্সি স্বহস্তে ক্ষমতা কুক্ষিগত করিতেছেন, এই অজুহাতে জেনারেল আল-সিসি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাইয়া মুর্সিকে বরখাস্ত করিয়া নিজে প্রেসিডেন্ট হইয়া বসেন। এই আল-সিসি গদিচ্যুত একনায়ক হোসনি মুবারকের স্নেহপুষ্ট জেনারেল এবং তিনি ক্ষমতা দখল করার পর মুবারক যাবতীয় অভিযোগ হইতে অব্যাহতিও পাইয়াছেন। স্বৈরাচারীরা অতএব গণবিক্ষোভে অপসারিত হইলেও ক্ষমতা পুনর্দখলের মতলবে থাকে এবং প্রথম সুযোগেই গণতন্ত্রে অন্তর্ঘাত করিয়া একনায়কত্ব ফিরাইতে তত্পর হয়। এসেবসি-ও কালক্রমে স্বৈরাচারী হইয়া উঠিবেন, এই আশঙ্কা টিউনিসিয়ার তরুণ সমাজকে হতাশাগ্রস্ত করিয়া তুলিতেছে।
তবে টিউনিসিয়া এবং মিশরের পরিস্থিতিতে পার্থক্য আছে। সেই পার্থক্য রচনা করিয়াছে গণতন্ত্র। আল-সিসির সামরিক অভ্যুত্থান এবং এসেবেসির নির্বাচনী সাফল্যকে একগোত্রে বসাইলে ভুল হইবে। নির্বাচনে জয়ী হইয়াও স্বৈরতন্ত্রের পথে অগ্রসর হইবার ঘটনা ইতিহাসে বিরল নহে, ত্রিশের দশকের জার্মানিতে সেই ইতিহাসের অবসান ঘটিয়াছে, এমন কথা মনে করিবারও কোনও কারণ নাই। কিন্তু তাহার পরেও ভরসা থাকিয়া যায়। ইতিহাসই সেই ভরসার উত্স। চরমপন্থী দল কী ভাবে গণতান্ত্রিক রাজনীতি এবং প্রশাসনের মূলস্রোতে আসিয়া ক্রমশ নিজেকে সেই মূলস্রোতের সহিত মানাইয়া লয়, কী ভাবে তাহার শুদ্ধি ঘটে, তাহার দৃষ্টান্তও বিরল নহে। স্বৈরতন্ত্র-উত্তর টিউনিসিয়ার অভিজ্ঞতা মিশর, লিবিয়া, সিরিয়ার অনুসরণ করে নাই, এখনও অবধি সে দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামো বজায় আছে এবং সক্রিয়ও আছে। সুতরাং আশা করিবার কারণ আছে যে, প্রেসিডেন্ট বেজি এসেবেসি আপন অতীত অপেক্ষা দেশের ভবিষ্যত্কে বেশি মূল্য দিবেন। গণতান্ত্রিক ভবিষ্যত্।