সম্পাদকীয় ২

গরিবের নামে

মানুষের মঙ্গল করিতে গিয়া মানুষের যে পরিমাণ অমঙ্গল সাধিত হইয়াছে, তাহার হিসাব চিত্রগুপ্তও শেষ করিয়া উঠিতে পারিতেন না। এই বিষয়ে তথাকথিত জনমুখী রাজনীতির কারবারিরা বরাবরই সিদ্ধহস্ত। আক্ষরিক অর্থেই, সস্তায় বাজিমাত করিতে তাঁহাদের চেষ্টার অন্ত নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১
Share:

মানুষের মঙ্গল করিতে গিয়া মানুষের যে পরিমাণ অমঙ্গল সাধিত হইয়াছে, তাহার হিসাব চিত্রগুপ্তও শেষ করিয়া উঠিতে পারিতেন না। এই বিষয়ে তথাকথিত জনমুখী রাজনীতির কারবারিরা বরাবরই সিদ্ধহস্ত। আক্ষরিক অর্থেই, সস্তায় বাজিমাত করিতে তাঁহাদের চেষ্টার অন্ত নাই। কোন পণ্য বা পরিষেবার কী দাম হওয়া উচিত, তাহার যোগ্য নির্ণায়ক চাহিদা ও জোগান। এই সরল সত্য জনমুখী রাজনীতিকরা মানেন না। চাহিদা এবং জোগানের স্বাভাবিক নির্দেশের তোয়াক্কা তাঁহারা করেন না, তাঁহাদের হুকুম: সস্তায় দিতে হইবে। এই বিষয়ে এ দেশের বামপন্থীরা দীর্ঘকাল অগ্রণী ছিলেন। তাঁহাদের ইস্তাহারে ও দাবিপত্রে এখনও ‘নিত্যপ্রয়োজনীয়’ পণ্যের এক লম্বা ফর্দ সন্নিবিষ্ট থাকে, সেই সকল পণ্য সরকারি উদ্যোগে অল্প মূল্যে পৌঁছাইয়া দেওয়াই তাঁহাদের মহান প্রতিশ্রুতি। এই বামমার্গীদের মনে করাইয়া দেওয়া বৃথা যে, তাঁহাদের মহাতীর্থ সোভিয়েত ইউনিয়নে এমন উদ্যোগের কী পরিণতি হইয়াছিল সে দেশের নাগরিকরা বিপণির সম্মুখে লাইন দেখিলেই দাঁড়াইয়া পড়িতেন, যখন যাহা মিলিতেছে তখন তাহাই কিনিয়া লইবেন, কারণ সর্বদা সব কিছুরই অভাব। এবং সর্বত্র দরিদ্রবান্ধব নীতির প্রকৃত কুফল ভোগ করেন দরিদ্ররাই, অ-সাধারণরা বরাবরই খিড়কি পথে আপন সামগ্রী সংগ্রহ করিয়া লন।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গ তথা কলিকাতার পরিবহণ ব্যবস্থা এই সত্যের এক উৎকট নজির। সস্তা বাস-ট্রামের আশীর্বাদ জারি রাখিতে অতীতের বামফ্রন্ট সরকার যতখানি যত্নবান ছিল, বর্তমান তৃণমূল কংগ্রেস সরকার তথা তাহার ইচ্ছাময়ী নেত্রী তাহার শতগুণ যত্নবান, তিন বছরের টানাপড়েনে এবং নাগরিকদের পরিবহণ ধর্মঘটজনিত বহু বিড়ম্বনার পরে শেষ অবধি ভাড়া কিছুটা বাড়িয়াছে, কিন্তু তাহা প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য। সস্তা পরিবহণের ঠেলায় শহরের রাজপথ হইতে বাস মিনিবাস ক্রমশই উধাও হইতেছে, সাধারণ যাত্রীদের দুর্ভোগ বাড়িতেছে, কিন্তু ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা, ভাড়া বাড়িতে দিবেন না। এত দিন তবু তাঁহার পরিবহণ মন্ত্রীকে ইতস্তত পরিবহণ বিষয়ে সুভাষিত বিতরণ করিতে দেখা যাইত, অধুনা, হয়তো অনিবার্য কারণে, তিনিও অদৃশ্য।

অথচ এই শহরেই শতাধিক নূতন সরকারি বাস পথে নামিয়াছে এবং দিব্য চলিতেছে। বাসগুলি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত, ভাড়া সাধারণ বাসের তুলনায় অনেকটাই বেশি। সেই বেশি ভাড়া মিটাইতে যাত্রীদের কিছুমাত্র আপত্তি নাই, বরং তাঁহারা খুশি হইয়া এই বাস ব্যবহার করিতেছেন, কারণ অনেকেই আগে আপন গাড়ির পেট্রোল পুড়াইয়া বা চড়া ট্যাক্সিভাড়া গনিয়া যাতায়াত করিতেন। সরকারি পরিবহণ সংস্থা স্বভাবতই এই বাসের সংখ্যা বাড়াইতে উৎসাহী। মুখ্যমন্ত্রী এই বর্ধিত ভাড়ায় আপত্তি তোলেন নাই। অন্তত এ-পর্যন্ত তোলেন নাই। তিনি নিশ্চয়ই মনে করিতেছেন, ‘বড়লোকের বাস’ বেশি ভাড়া চাহিলে তাঁহার গরিবদরদি ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় না। ঠিকই ভাবিতেছেন। তাঁহার পূর্বসূরিরাও ঠিক এমনটিই ভাবিতেন। বিপদ গরিবের। এই ভাবমূর্তির মাশুল তাঁহাদেরই গনিতে হয়। সাধারণ যাত্রী আরও কিছু বেশি ভাড়া দিতে সম্মত, কিন্তু সেই সুযোগ তাঁহাকে দেওয়া হইবে না, রাজপথ হইতে তাঁহার বাস ক্রমশই উধাও হইবে। রাজনীতির কারবারিদের ভাবমূর্তি সেই অনুপাতে লম্বা হইবে। সর্দার পটেলের প্রস্তাবিত প্রতিমাও তাহার সহিত পাল্লা দিতে পারিবে না। ইহাই জনমনোরঞ্জনী রাজনীতি।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন