সম্পাদকীয় ২

চিন ও ভারত

যাহা প্রাচীন, তাহাই অভ্রান্ত নহে। চিন এই সত্যটি অনুভব করিয়াছে বলিয়াই চিনা গবেষক এ বৎসর চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পাইলেন। থু ইয়োউইয়োউ চিনের সাবেকি চিকিৎসায় প্রচলিত উদ্ভিদ হইতে একটি ঔষধ প্রস্তুত করিয়াছেন। ম্যালেরিয়া নিরাময়ে তাহার কার্যকারিতা প্রমাণিত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০২
Share:

যাহা প্রাচীন, তাহাই অভ্রান্ত নহে। চিন এই সত্যটি অনুভব করিয়াছে বলিয়াই চিনা গবেষক এ বৎসর চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পাইলেন। থু ইয়োউইয়োউ চিনের সাবেকি চিকিৎসায় প্রচলিত উদ্ভিদ হইতে একটি ঔষধ প্রস্তুত করিয়াছেন। ম্যালেরিয়া নিরাময়ে তাহার কার্যকারিতা প্রমাণিত। কিন্তু এই পুরস্কার প্রাচীন চিনা চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রতি অর্ঘ্য নহে। ওই চিনা বিজ্ঞানী প্রাচীন শাস্ত্র-কথিত উদ্ভিদ হইতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কার্যকর রাসায়নিক যৌগটি নিষ্কাশন করিয়া তাহা হইতে আধুনিক চিকিৎসায় ব্যবহারযোগ্য ঔষধ প্রস্তুত করিয়াছেন। ইহা তাঁহার সেই বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি। তিনি চিনা চিকিৎসাবিজ্ঞানের চর্চার জন্য গঠিত সংস্থায় এই গবেষণা করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার গবেষণা সমসাময়িক বিজ্ঞানের সকল শর্ত পূরণ করিয়াছে। এই বিজ্ঞানসম্মত, যুক্তিনির্ভর মনোভাব চিন দেশে আছে বলিয়াই বিজ্ঞান-প্রযুক্তি চর্চায় তাহার দ্রুত উন্নতি ঘটিতেছে। চিন তাহার ঐতিহ্যকে অবজ্ঞা করে না, কিন্তু তাহার পরিচয় অতীতে খোঁজে না। আধুনিক বিজ্ঞানই আধুনিক চিনের পরিচয়। বিজ্ঞানে প্রথম নোবেলটি লাভ করিবার পরে সে দেশের মুখ্য বিজ্ঞানীরা সতর্ক করিয়াছেন, প্রাচীন চিকিৎসায় ব্যবহৃত উদ্ভিদ লইয়া পরীক্ষা করা যাইতে পারে, কিন্তু আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান মানিয়াই। লক্ষণীয়, আজ চিনে আধুনিক চিকিৎসায় প্রশিক্ষিত ডাক্তার ১১ লক্ষ। সাবেকি চিনা পদ্ধতির চিকিৎসক মাত্র ১ লক্ষ ৮৬ হাজার।

Advertisement

ভারতে ছবিটি কেমন? এ দেশে এমবিবিএস ডিগ্রিপ্রাপ্ত ডাক্তারের সংখ্যা প্রায় আট লক্ষ। অন্যান্য বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিতে (আয়ুর্বেদ, সিদ্ধা, ইউনানি, হোমিয়োপ্যাথি, প্রভৃতি) নথিভুক্ত ডাক্তারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ। পশ্চিমবঙ্গে এমবিবিএস ডিগ্রিপ্রাপ্ত ডাক্তারের অপেক্ষা (প্রায় ৫০ হাজার) হোমিওপ্যাথের সংখ্যা খুব কম নহে (৩৬,০০০)। সরকারকে সকল চিকিৎসাপদ্ধতির সমান পৃষ্ঠপোষকতা করিতে হইবে, এমনই মনোভাব ভারতে। ফলে বিভিন্ন ফার্মাকোপিয়া লইয়া আধ ডজন চিকিৎসাধারা সহাবস্থান করিতেছে। লোকে ইচ্ছা মতো কখনও একটি, কখনও অপরটি, কখনও বা একই সঙ্গে একাধিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা করাইতেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিকল্প চিকিৎসার কারবারিরা আধুনিক বিজ্ঞানে ঔষধের কার্যকারিতা এবং ঝুঁকিহীনতা প্রমাণের কঠোর শর্তগুলি এড়াইতেই ঐতিহ্যের ধ্বজা তুলিয়া ধরেন। প্রাচীন ঔষধের কার্যকারিতা লইয়া প্রশ্ন তুলিলে ‘ঐতিহ্যের উপর আক্রমণ’ বলিয়া গোলযোগ শুরু হয়।

পাশ্চাত্যের সহিত স্পর্ধা করিয়া ভারতের প্রাচীন শাস্ত্রগুলিকে উন্নততর, আধুনিকতর বলিয়া দেখাইবার অপচেষ্টারও কসুর নাই। ভারতে সরকারের প্রধান উদ্বেগ, ভারতে প্রচলিত সাবেকি উদ্ভিদগুলির ‘পেটেন্ট’ লইয়া কোনও বহুজাতিক না ব্যবসা ফাঁদিয়া বসে। সে উদ্দেশ্যে বিদেশি মুদ্রা ব্যয় করিয়া আন্তর্জাতিক আদালতে সরকার মামলাও লড়িয়াছে। কিন্তু প্রাচীন শাস্ত্রে উল্লিখিত উদ্ভিদ হইতে মূলস্রোতের চিকিৎসার উপযোগী ঔষধ তৈরির কাজটি গুরুত্ব পায় নাই। আজ প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে উল্লিখিত কোনও উদ্ভিদ হইতে প্রাপ্ত ঔষধ যদি নোবেল পুরস্কার পাইত, তাহা হইলে আয়ুর্বেদের জয়নিনাদে কান পাতাই দায় হইত। চিনা বিজ্ঞানীদের মতো কেহ মনে করাইয়া দিতেন না বা দিবার সাহস পাইতেন না যে, আধুনিক বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে প্রাচীন বিদ্যাকে পরীক্ষা করিতে হইবে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement