ছুটিপ্রিয় বঙ্গবাসীর মুখে হাসি ফুটাইতে মুখ্যমন্ত্রী প্রায়শ অতিরিক্ত ছুটি ঘোষণা করিয়া থাকেন। দোলের দিন রাজ্য সরকারের ছুটির পর পরের দিনটিও হোলি’র অজুহাতে রাজ্য সরকার ছুটি করিয়া দিয়াছে। অর্থাত্ বৃহস্পতিবার শুরু হইয়া রবিবার অবধি টানা চার দিনের সপ্তাহান্তিক ছুটি। এই মধ্য-ফাল্গুনে দিঘা-মন্দারমণি কিংবা দার্জিলিং-ডুয়ার্স-এর পক্ষে একেবারে যথাযথ। ইহাতে নূতনত্ব কিছু নাই। তবে কলিকাতা হাইকোর্টে ইহার প্রতিক্রিয়া তাত্পর্যপূর্ণ। প্রধান বিচারপতি ওই দিন আদালত খোলা রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিয়া আইনজীবীদের হাজির থাকার আর্জি জানাইলেও বার অ্যাসোসিয়েশন কর্ণপাত করিতে নারাজ। বঙ্গীয় বৃত্তিজীবীদের মানসিকতা ও কর্ম-সংস্কৃতির চিত্রটি যত্পরোনাস্তি খোলসা হইয়া গেল। বিচারপ্রার্থী জনসাধারণ আদালতে হাজির হইলেও এবং বিচারপতিরা সেখানে উপস্থিত থাকিলেও আইনজীবীদের গরহাজিরায় তাঁহাদের ফিরিয়া যাইতে হইবে— চমত্কার কর্ম-সংস্কৃতি!
অথচ আদালতের প্রতিটি এজলাসে বকেয়া মামলার পাহাড় জমিয়া রহিয়াছে। বস্তুত জমিয়া থাকা মামলার নিষ্পত্তি করিতে বহু বত্সর লাগিয়া যাইবে। তত দিনে আরও লক্ষ-হাজার মামলা দায়ের হইবে। বকেয়া মামলাগুলির নিষ্পত্তি করিতে বছরে আদালত খোলা থাকার দিন বাড়ানো দরকার, এত দিন ধরিয়া ভোগ করিয়া আসা বিপুল পরিমাণ ছুটির সংখ্যা হ্রাস করিয়া কাজের দিন বৃদ্ধি করা আবশ্যক। মাননীয় প্রধান বিচারপতি এবং তাঁহার পূর্বসূরিও এই প্রশ্নে জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিবার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু আইনজীবীরা বিশেষাধিকার হাতছাড়া করিতে প্রস্তুত নন। তাই সুযোগ পাইলেই, ঘোষিত ছুটির বাহিরেও, অঘোষিত ছুটির জন্যও তাঁহারা সতত উশখুশ করেন, কোনও সহকর্মীর প্রয়াণ ঘটিলেই ছুটির আবদার করা হয়। এই জবরদস্তি, কেবল নিজেদের সুখ-সুবিধার অনন্ত বিস্তার ঘটাইবার প্রবণতা, বিচারপ্রার্থী জনসাধারণের অসহায়তার প্রতি নিষ্ঠুর ঔদাসীন্যের এই ঐতিহ্য রাজ্যের আইনজীবীদের একাংশের চরিত্রলক্ষণ হইয়া উঠিয়াছে। সরকারি কর্মচারীদের মতোই তাঁহারা কর্মভীরু এবং ছুটিপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছেন।
মাননীয় প্রধান বিচারপতি অবশ্য দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাইয়া দিয়াছেন, রাজ্য সরকারের নবনব উদ্ভাবনশীল ক্যালেন্ডার সতত পরিমার্জিত হইতে পারে, তবে হাইকোর্টের ক্যালেন্ডার আলাদা। সেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী হোলির দিন কোনও ছুটি নাই এবং তিনি ও হাইকোর্টের অন্যান্য বিচারপতিরা তাঁহাদের এজলাস বিচারপ্রার্থীদের জন্য খোলা রাখিবেন। প্রবীণ আইনজীবীদের একাংশ ওই সব এজলাসে কাজে যোগও দিবেন। তাঁহারা এমন কথায়-কথায় ছুটির পক্ষপাতী নন। প্রধান বিচারপতির এই দৃঢ় অবস্থান ও তাহার প্রতি আইনজীবীদের একাংশের সমর্থন একটি ইতিবাচক লক্ষণ। ইহা সর্বোচ্চ প্রশাসনিক স্তর হইতে চালু করা ছুটির সংস্কৃতি ও কাজে-ফাঁকির প্রবণতাকে অন্তত হাইকোর্ট-প্রাঙ্গণ হইতে ধাপে-ধাপে নির্বাসিত করিতে সক্ষম হইতে পারে। এক বারে ইহা হইবার নয়। তবে জনতোষণ ও সস্তা মনোরঞ্জনের অভ্যস্ত সড়কে না হাঁটা প্রধান বিচারপতির দৃঢ় অবস্থান অন্তত রাজ্যের সামনে একটা স্বাস্থ্যকর ও বিকল্প দৃষ্টান্ত তো স্থাপন করিতেছে। এই নিরন্তর অতলান্ত অপ্রাপ্তির গহনে সেটাই বা কম পাওনা কি!