উত্তেজিত সোনালি গুহ পশ্চিমবঙ্গের পরম সত্যটি উচ্চারণ করিয়া ফেলিয়াছেন: তিনি মুখ্যমন্ত্রীর ‘ম্যান’। কেবল তিনি নহেন, কালীঘাটের স্নেহাশিসধন্য প্রত্যেকেই এই রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর ম্যান। তাঁহারা আর নিজেদের কোনও পৃথক ব্যক্তিসত্তায় দেখেন না, মুখ্যমন্ত্রীর পরিবর্ধিত অংশ হিসাবেই আজ তাঁহাদের আত্মপরিচয়। বস্তুত, মুখ্যমন্ত্রী তাঁহাদের মধ্যে নিজের ছায়া দেখিয়াছিলেন বলিয়াই তাঁহারা ক্ষমতার বলয়ে প্রবেশাধিকার পাইয়াছিলেন। এখন কায়া আর ছায়ার প্রভেদ ঘুচিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গ আজ প্রকৃত অর্থেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-শাসিত। এই রাজ্যের ক্ষমতার প্রতিটি কেন্দ্রে, প্রতিটি বিন্দুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধিষ্ঠান। প্রত্যেকেই সরকার। প্রত্যেকেই চিফ মিনিস্টার। অতএব, বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার বেআব্রু দাদাগিরিতে মাতিয়া উঠিলে তাহাতে আঘাত পাইবার, অথবা অবাক হইবার, বিন্দুমাত্র কারণ নাই। ডেপুটি স্পিকারের ন্যায় সম্মানের আসনে সোনালি গুহরা অধিষ্ঠিত হইলে ইহা স্বাভাবিক পরিণতি। প্রশ্ন যদি করিতেই হয়, তবে ডেপুটি স্পিকার পদে সোনালি গুহকে বসাইবার যৌক্তিকতাকে প্রশ্ন করা বিধেয়। তাঁহার পূর্বাশ্রমে এমন কোনও উদাহরণ নাই যাহাতে তিনি এই পদের যোগ্য হিসাবে বিবেচিত হইতে পারেন। বরং, স্বাভাবিক বুদ্ধি বলিবে, যিনি বিধানসভায় ভাঙচুরে নেতৃত্ব দিতে পারেন, তাঁহাকে নিরাপদ দূরত্বে রাখাই বিধেয়। কিন্তু, নিজের ছায়া প্রতিষ্ঠার অদম্য তাগিদ মুখ্যমন্ত্রীকে এই স্বাভাবিক বিবেচনাবোধের দ্বারস্থ হইতে দেয় নাই। তাহার পরিণতি সিসিটিভি-র ফুটেজে ধরা পড়িয়া গোটা দেশের সম্মুখে পশ্চিমবঙ্গের মাথা হেঁট করিয়াছে।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই নিজের ছায়া প্রতিষ্ঠার তাগিদটি বঙ্গেশ্বরীর পূর্বে এই রাজ্য দেখে নাই, এমন দাবি ইতিহাস মানিবে না। লোকাল কমিটির দোর্দণ্ডপ্রতাপের স্মৃতি জনমানসে হয়তো ঈষত্ ম্লান হইয়াছে, হারাইয়া যায় নাই। সেই লোকাল কমিটি কোনও ব্যক্তির ছায়া ছিল না। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের প্রতিভূ ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির সহিত তৃণমূল কংগ্রেসের তফাত যেখানে, লোকাল কমিটির সহিত সোনালি গুহদেরও ফারাক সেখানেই প্রথমটিতে পার্টিই সব, দ্বিতীয়টিতে দলের ইচ্ছাময়ী নেত্রী। লোকাল কমিটির নিয়ন্ত্রণ এক অর্থে আরও অনেক মজবুত ছিল। তাহারা কাহার লোক, সেই কথাটি কমিটিকে কখনও তর্জনী উঁচাইয়া ঘোষণা করিতে হয় নাই। মানুষ জানিতেন। বঙ্গেশ্বরী তাঁহার পূর্বসূরিদের চাল নকল করিয়াছেন, মন্ত্র শিখিবার ফুরসত পান নাই। তাঁহার ছায়ারাও স্বেচ্ছাচার শিখিয়াছেন, আস্ফালন শিখিয়াছেন। যাঁহারা, অত্যন্ত সঙ্গত কারণে, আজ নিজেদের ‘সরকার’ জ্ঞান করিতেছেন, তাঁহাদের নিকট ক্ষমতার একটিই উপযোগিতা— অপব্যবহার।
যাঁহারা এখন বঙ্গেশ্বরীকে ঘিরিয়া থাকেন, এবং সেই সুবাদে রাজ্য রাজনীতির আংশিক নিয়ন্তা, তাঁহাদের অনেকেরই অতীত বর্তমানের ক্ষমতা ও সম্মানের সহিত মানানসই নহে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁহাদের বিলক্ষণ চেনেন, তাঁহাদের অতীতও জানেন। তবুও তিনি তাঁহাদেরই নিজের ঘনিষ্ঠ বলয়ে ঠাঁই করিয়া দিয়াছেন। সম্ভবত, নিজের ছায়া দেখিয়াছেন বলিয়াই। এই উপগ্রহদের কেন্দ্র করিয়া আরও ছায়া ঘোরে। সোনালি গুহদের অবস্থান এই জ্যোতির্মণ্ডলীর বিভিন্ন বিন্দুতে। নেত্রীর প্রতি আনুগত্যই তাঁহাদের প্রধান যোগ্যতা। অতএব, বিধানসভার স্পিকার হইতে কলিকাতার শেরিফ, নিজ পদমর্যাদার কথা বিস্মৃত হইয়া দলীয় মিছিলে পা মিলাইতে কাহারও সংকোচ হয় না। থানায় হামলা করিতে, সাংবাদিকদের সহিত দুর্ব্যবহার করিতে, বিরোধীদের সভার অনুমতি না দিতেও নহে। এই ছায়াময় রাজ্যে মহানেত্রীর মনোমত হওয়ার অধিক লক্ষ্য নাই, নেত্রীর গাড়ির আসন অপেক্ষা সম্মাননীয় কুর্সি নাই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সত্য, কারণ তাঁহার ছায়াতেই এই রাজ্য ঢাকা পড়িয়াছে। পূর্ণগ্রাস।