ক’দিন আগে মুসলমান সমাজের ‘বিয়ে গাউনি’দের নিয়ে একটা নাটক দেখে বেরনোর সময়, যেমন হয়, বাবা মা আর তাঁদের তরুণী কন্যা নাটকটা নিয়ে মত চালাচালি করছিলেন। ছেঁড়া-ছেঁড়া সংলাপের মধ্যে কানে এল সেই বহু চেনা কথাটা ‘মুসলমানদের মধ্যে তো আর সবাই খারাপ নয়’। বেশ একটা সংবেদনের অনুভব ছিল তাঁদের উচ্চারণে। এক বছরে ত্রিশটি প্রায়-ভরা প্রেক্ষাগৃহে অভিনয় হয়েছে। নাটক তো দেখে সেই শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত, মুসলমানদের সঙ্গে যাদের পরিচয় এমনই ছকবন্দি। অপরিচয়, অজ্ঞতা, সন্দেহ নিয়ে তাঁরা মুসলমানদের যতটা না ক্ষতি করতে পারছেন, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করছেন নিজের। একটা একপেশে আধলা ধরনের বাঙালি সমাজ তৈরি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। সেখানে সবার অংশগ্রহণ নেই। ২৭ ভাগ মানুষকে ‘অপর’ করে রেখে যেমন হতে পারে একটা সমাজ। না হলে বিজ্ঞ প্রবীণ নামী পরিচালক গ্রামীণ পটে বাঁধা ওই নাটকে সব পুরুষ চরিত্রকে কেন টুপি-দাড়িতে সাজাবেন। তাঁর হয়তো সন্দেহ ছিল, টুপি-দাড়ি ছাড়া আমরা মুসলমান চিনব কিনা। আমার দেখা বাংলার গ্রামের কিছু প্রবীণ মানুষ বাদ দিলে দরগা-মসজিদ-মাদ্রাসার সঙ্গে যুক্ত লোকেরাই কেবল দাড়ি রাখে, টুপি পরে। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের টুপি বা দাড়ি দুটোই বিলাসিতা। বাংলা মঞ্চের নামী পরিচালক এটা কেন খেয়াল করবেন না। খেয়াল আমরা করি না, করতে ভুলে যাই, কারণ বহু দিন ধরে আঁকের ওপর আঁক বুলিয়ে তৈরি করা মোটা দাগে মুসলমানের একটা ছবি কলকাতার শিক্ষিত হিন্দু বাঙালি সযত্নে লালন করে। তার থেকে সে বেরোতে চায় না কখনও।
পুরনো বস্তাপচা কথাগুলো কত বার বলা হল। তবু বলতে হয়, আবারও বলতে হয়।
আরও আছে। সেই ছবির মুসলমান মৌলবাদী, সংকীর্ণমনা, জাতীয় মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন এবং সম্ভাব্য সন্ত্রাসবাদী। কোনও পুরনো মসজিদের সংস্কারে হাত পড়লে সেখানে পেট্রো ডলারের গন্ধ থাকবে আর ‘ওরাই’ তো মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ থেকে ডেকে-ডেকে লোক নিয়ে আসছে (পড়ুন অনুপ্রবেশকারী), সব মুসলমানই এক রকম, সরকারি তোষণ আদায় করতে ব্যস্ত, ভোটব্যাঙ্ক ইত্যাদি ইত্যাদি অসংখ্য মিথ্যের মধ্যে দিয়ে শিক্ষিত হিন্দু বাঙালি তার প্রতিবেশী মুসলমানকে দেখতে চায়। মিথ্যেগুলোকে শুধরে না নিলে বড় বিপদ আমাদের সামনে।
এত দিনে বোধহয় স্পষ্ট যে, উন্নয়নের স্বার্থেই দেশে শিিক্ষত, অর্থনৈতিক ভাবে শক্তপোক্ত সংখ্যালঘু প্রয়োজন। রাজ্যের ২৭.৮ শতাংশ মানুষকে নিরক্ষরতা, দারিদ্র আর সাংস্কৃতিক পশ্চাদপদতার মধ্যে ফেলে রাখলে কারও পক্ষে ভাল হবে না, তারা সবাইকে নিয়ে নীচের দিকে নামতে থাকবে। এ রাজ্যের মানব উন্নয়ন সূচকেই তার যথেষ্ট প্রমাণ। স্বাধীনতার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের অনগ্রসরতা নিয়ে বিস্তর কথা হয়েছে। কিন্তু তাদের উন্নতি বিশেষ হয়নি। সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের ন’বছর পরেও অবস্থা বিশেষ বদলায়নি। সম্প্রতি প্রকাশিত কুণ্ডু কমিটির রিপোর্ট সেটাই বলছে। সংখ্যালঘু তথা মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক মূল্যায়ন করার জন্য এবং সংখ্যালঘু উন্নয়নে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের পনেরো দফা কর্মসূচি কতটুকু কার্যকর হয়েছে, তা জানতে জেএনইউ-র অধ্যাপক অমিতাভ কুণ্ডুর নেতৃত্বে একটি কমিটি তৈরি হয় ইউপিএ আমলের শেষের দিকে। সেই রিপোর্ট সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রকে জমা পড়ে গত সেপ্টেম্বর মাসে। কুণ্ডু কমিটির রিপোর্ট জানাচ্ছে, গ্রামীণ মুসলমানদের দারিদ্র ২০০৪-০৫ সালে যেমন ছিল, ২০১১-১২-তেও তেমনই জাতীয় গড়ের থেকে অনেক বেশি। প্রাথমিক স্তরে মুসলিম ছাত্রছাত্রী যথেষ্ট থাকলেও মাধ্যমিক পর্যন্ত পৌঁছতে পারছে না অনেকেই। স্কুলছুটের সংখ্যা হিন্দুদের থেকে অনেক বেশি।
কাছাকাছি সময়ে স্ন্যাপ ইন্ডিয়া নামে কলকাতার একটি সংগঠনও এই রাজ্যের মুসলমানের আর্থ-সামাজিক এবং শিক্ষার প্রকৃত অবস্থা জানতে রাজ্য জুড়ে মাঠপর্যায়ের সমীক্ষা চালিয়ে ‘পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের অবস্থা’ নামে একটা রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখানেও যে ছবি পাওয়া গিয়েছে, তা মোটে আশাব্যঞ্জক নয়। গোটা সমাজের উন্নয়নের ধারার সঙ্গে যদি মুসলমান পা মেলাতে না পারে, তা হলে সামগ্রিক উন্নয়নটাই ব্যাহত হবে। সে সবাইকে পিছন থেকে টেনে ধরবে। এটাই নিয়ম, এ রকমই হয়। লাগাতার অনুন্নয়নের মধ্যে থাকার ফলে মোল্লা-মৌলবীদের দৌরাত্ম্য প্রবল থাকে সমাজে। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, মুক্তচিন্তা বা বাক্ স্বাধীনতার ব্যাপারে অসহিষ্ণুতা, ধর্মপরিচয় নিয়ে বাড়াবাড়ি সবই সমাজের পশ্চাদপদতার সঙ্গে যুক্ত। এই কারণেই দাড়ি-টুপি শোভিত মৌলবাদীরাই হয়ে উঠতে পারে মুসলমান সমাজের নেতা। সমাজের এই অবস্থা যতটা না ধর্মীয় কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুপস্থিতির জন্য।
আবার, নিরক্ষরতা এবং দারিদ্রের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে জড়িয়েও থাকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অভিশাপ। তা যেমন সমাজ ও দেশের ভাল করে না, তেমনই সেই পরিবারেরও সর্বনাশ ডেকে আনে, যে-পরিবার অন্নের সংস্থান ছাড়াই ফি-বছর বাড়িয়ে চলে সদস্যের সংখ্যা। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিক এবং বুদ্ধিজীবীরা মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে ‘অবাধ অনুপ্রবেশ’ যুক্ত করে মূল সমস্যাটাকেই আড়ালে ঠেলে দেন। ২০১১ সালের জনগণনার রিপোর্টের যেটুকু আমাদের গোচরে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আগের ২০০১-এর মতো ২০১১-তেও জাতীয় গড়ের থেকে বেশি। কিন্তু এটাও সবার জানা যে, নিরক্ষরতা, দারিদ্র, অনুন্নয়নের সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সম্পর্ক গভীর। এ রাজ্যে হিন্দু মেয়েদের সাক্ষরতার হার ৬৩.১ শতাংশ আর মুসলমান মেয়েদের ৪৯.১। সরকারি চাকরিতে মুসলমানের সংখ্যা নামমাত্র (৪.১ শতাংশ)। পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ৩.০৭ শতাংশ ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায়। স্ন্যাপ-সমীক্ষা থেকে রাজ্যের মুসলমান সমাজের অবস্থার একটা ছবি পাওয়া গেছে। জানা েগছে, মুসলমান সমাজের ৪২.৬ শতাংশ মানুষ কাগজ কুড়ুনি, ঝি-চাকর, নির্মাণ শ্রমিক, কুলি, মজুর জাতীয় দিন-আনা দিন-খাওয়া গোছের কাজে যুক্ত।
একটা সমাজে শিক্ষিত মধ্যবিত্তই যদি তৈরি না হতে পারে, তা হলে সেই সমাজের স্বতঃপ্রণোদিত জন্মনিয়ন্ত্রণ হবে কী করে? আমরা দেখেছি সচ্ছল ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলমান পরিবারে জন্মহার একই আর্থ-সামাজিক অবস্থার হিন্দুদের থেকে বেশি নয়। জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা নেই। নেই, তার কারণ জন্মনিয়ন্ত্রণ কোনও বিচ্ছিন্ন কাজ নয়। ইমাম মোয়াজ্জিনদের জন্য ভাতা দেওয়ার মতো কোনও ঘোষণা দিয়ে এ কাজ হবে না। শিক্ষা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের প্রকৃত সাফল্য। তার জন্য চাই সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সেই সদিচ্ছা কোনও সরকারই দেখায়নি। উল্টে মুসলমান সমাজের এক শ্রেণির স্বঘোষিত মোড়ল জন্মনিয়ন্ত্রণে বাধা দিলে প্রশাসন তা নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না।
ধীরে ধীরে ছবিটা বদলাচ্ছে। বাংলায় মুসলমানের একটা নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে। সুশীল, শিক্ষিত, প্রত্যয়ী সেই সব মুখের দেখা মিলছে রাজ্যের প্রায় সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে, মেডিক্যাল কলেজ আর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। কয়েক মাস আগে খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণের পর সমস্ত মুসলমানকে যখন মাদ্রাসা আর মৌলবাদীদের সঙ্গে এক করে প্রচার তুঙ্গে, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝকঝকে মুসলিম তরুণ-তরুণীরা মাদ্রাসা শিক্ষার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। জেনে রাখা ভাল, মুসলমান সমাজের মাত্র তিন থেকে চার শতাংশ হতদরিদ্র প্রায় ‘এতিম’ সন্তান খারিজি মাদ্রাসাগুলিতে পড়ে। সেখানে শিক্ষা বা জীবনযাপন অত্যন্ত নিম্ন মানের। দান আর ভিক্ষা অন্নে বেঁচে থাকা ওই ব্যবস্থায় কোনও প্রত্যয়ী মানুষ তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। মুসলমান সমাজের শিক্ষিত মানুষদের কেউ কেউ মনে করেন, এই মাদ্রাসা শিক্ষার বিলোপ ছাড়া মুসলমান সমাজের দুর্নাম ঘুচবে না, সাংস্কৃতিক মূলধারায় সে পা রাখতে পারবে না। এটা সম্ভবত খাগড়াগড়ের ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। তা থেকে অন্তত বোঝা গেল, মুসলমান সমাজে এমন করে ভাবতে পারা এবং তা প্রকাশ্যে বলার মতো পরিসর তৈরি হচ্ছে। মোল্লা-মৌলবীদের মুঠি আলগা হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা সামাজিক উদ্যোগে জেলায় জেলায় প্রচুর মিশন স্কুল তৈরি করেছে। সেখানে সরকারি নিয়ন্ত্রণ বা আর্থিক সহায়তা নেই। নিজেদেরই পরিচালিত জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করে সেই সব আবাসিক মিশন স্কুলে ভর্তি হতে হয়। ফি-বছর গ্রামগঞ্জের হাজার ছেলেমেয়ে সেখানে পড়ছে, ভাল ফল করছে এবং প্রতিবছর ডাক্তারিতে, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। তারাই পাশ করে বিদেশে গবেষণা করতে যাচ্ছে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে, সরকারি আমলার পদে বসছে, কর্পোরেট দফতরে দায়িত্বের কাজ করছে। সংবাদপত্রে পাত্র-পাত্রীর কলমে চোখ রাখলেও এই পরিবর্তনের একটা আভাস পাওয়া যায়। উচ্চশিক্ষিত মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র খুঁজতে নাকাল হচ্ছেন বাবা-মা। এরাই মুসলমান বাঙালির নতুন মুখ। এ কেবল কয়েক জন ব্যক্তি বা পরিবারের অগ্রগতি নয়, গোটা বাঙালি সমাজের পরিবর্তনের সূচক। মিশন স্কুলগুলো থেকে প্রত্যন্ত বাংলার এমন সব পরিবারের ছেলেমেয়েরা ভাল ফল করে ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাচ্ছে, যারা কোনও দিন তেমন স্বপ্ন দেখারও সাহস করত না। পিছিয়ে থাকা একটা সমাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। মুসলমান বাঙালির এই অর্জনের বার্তা চাপা পড়ে থাকে খাগড়াগড়ের জঙ্গি যোগাযোগের খবরের নীচে। মাদ্রাসা ছাত্র ইউনিয়ন, জামাতে ইসলাম কিংবা উলেমাদের ডাকা বিশাল জনসভায় ভয় ধরানো হুংকারে ঢাকা পড়ে যায়। সমাজের মোড়ল সেজে বসে আছেন ধর্ম আর রাজনীতির যে লোকেরা, তাঁদেরও বিশেষ আগ্রহ নেই এ খবরে।
সে দিন নাটক দেখে বেরনোর সময় ভাবছিলাম, সেকুলার শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত আমাদের নিকট প্রতিবেশীদের এই নতুন অর্জনের খবর ঠিক ক’জন রাখি?