এখন। মেদিনীপুর থেকে লালগড়ের পথে। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।
লালগড়ে প্রথম গিয়েছিলাম ১৯৮১ সালে। তার পর অনেক বার গেছি। মাঝে হঠাত্ই এক দিন লালগড় হয়ে গেল আউট অব বাউন্ডস প্রবেশ নিষেধ। সেই অবস্থার নিরসন হওয়ার পর থেকেই সুযোগ খুঁজছিলাম লালগড় ও জঙ্গলমহলের অন্য ব্লকগুলি ঘুরে দেখার। ২০০৯ সালে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে যে অভিযান শুরু হয়েছিল শুধু লালগড়েই নয়, পশ্চিবঙ্গের অন্য অঞ্চলে, ঝাড়খণ্ডে, ওড়িশায়, ছত্তীসগঢ়ে তার উদ্দেশ্য ছিল মাওবাদীদের হাত থেকে এলাকাগুলি উদ্ধার করে সেখানে উন্নয়নের কাজ ত্বরান্বিত করা। ২০১১ সালের শেষ থেকে লালগড় ও সংলগ্ন অঞ্চল মাওবাদের বা রাওবাদের, যা-ই বলুন, প্রভাবমুক্ত। এই সুযোগ প্রশাসন কী ভাবে কাজে লাগাচ্ছেন, দেখার ইচ্ছে ছিল। মাওবাদী সমস্যার মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকার দেশের ৮২টি জেলায় বিশেষ অনুদানের ব্যবস্থা করেছে। পশ্চিম মেদিনীপুর সেই থেকে বছরে ৩০ কোটি টাকা পাচ্ছে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কোন কোন প্রকল্পে কাজে লাগছে? জেলা প্রশাসন এই কাজে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন, সাধারণ মানুষই বা কী ভাবছেন সবই একটু বুঝতে চাইছিলাম।
পুলিশি অভিযান যত দিন চলেছে, সাংবাদিকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে, অনেক ঝুঁকি নিয়েও সব খবরই আমাদের দিয়েছেন। তারও আগে, ছত্রধরের আন্দোলনের সময় যাদবপুরের দাদামণি-দিদিমণিরা, ডকু-ফিল্ম নির্মাতা, চিত্রকার, কথাশিল্পী, অনেকেই এসেছেন, দেখেছেন, লিখেছেন। সবারই মনে হয় প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তাঁরা আর লালগড়ে আসেন না। জঙ্গলমহলের পুনর্নির্মাণ পর্বের কথা বলার লোক নেই।
১৯৮৫ সালে যখন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে মেদিনীপুরে যাই, তখন আমরা কাজ করেছি ১৯৮৩ সালে নির্বাচিত পঞ্চায়েতের সঙ্গে। দেখেছিলাম পঞ্চায়েতের অনেক সদস্যই কাজ বোঝেন এবং কাজ তোলার ব্যাপারে বিশেষ ভাবে উত্সাহী। সেই পরিবেশটা উপভোগ করেছিলাম বলেই অনেকেরই নাম আজও মনে আছে। আমার ঠিক কুড়ি বছর পরে যিনি এই জেলায় আসেন, তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন একটি বইয়ে: ‘কিন্ডলিং অব অ্যান ইনসারেকশন’। বইটি পড়ে আমার মনে হয়েছিল, সেই পঞ্চায়েতই কুড়ি বছর পর হয়ে উঠেছিল সরকারি প্রকল্প রূপায়ণের পথে প্রধান বাধা। আগ্রহ ছিল দেখার যে, ২০১৩ সালের সদ্য নির্বাচিত পঞ্চায়েত কেমন কাজ করছেন। প্রশাসনের সঙ্গে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সম্পর্ক কেমন? কাজের পরিবেশ কি সেই আশির দশকের মতো, না কুড়ি বছর পরে যা দেখা গিয়েছিল, সেই রকম? দেখলাম, জেলার অফিসারেরা এবং পঞ্চায়েতের সদস্যরা সমান উত্সাহ নিয়ে কাজে লেগে আছেন। জেলাশাসকের মত হল, কয়েকটি এলাকা ছাড়া সব জায়গাতেই সম্পর্ক ভাল।
বেলপাহাড়ি থেকে আধঘণ্টা লাগল ডাকাইত গ্রামে পৌঁছতে। ঝাড়খণ্ড সীমানায় ছোট্ট এই গ্রামে আইসিডিএস সেন্টারের কোনও ঘর ছিল না। একটি চালার নীচে বসা হত বাচ্চাদের নিয়ে। খিচুড়ি হতে যত ক্ষণ সময় লাগে, তত ক্ষণই বসত বাচ্চারা। তার পর, খেয়েই বাড়ি ফেরা। সেই সেন্টারের নতুন বাড়ি হয়েছে। ধবধবে সাদা বাড়িটিতে একটি বড় হলঘর, বাইরে বারান্দা। আছে রান্নাঘর, ভাঁড়ারঘর, শৌচালয়। সব দেওয়ালেই নানা রঙের অজস্র ছবি ফুলের, ফলের, জীবজন্তুর, পাখির। দেওয়ালের নীচের অংশ খালি রাখা আছে, বাচ্চারা নিজেরাও যাতে আঁকতে পারে।
একই রকম আর একটি সেন্টার দেখলাম সাঁকরাইলের তালাই গ্রামে। লোধা সম্প্রদায়ের গ্রাম। তাঁরাই জমি দিয়েছেন ঘরের জন্য। পাশে বাচ্চাদের খেলার জায়গা। সব্জি লাগানো হচ্ছে একটি প্লটে। এ ছাড়াও একটি ঝুড়ি আছে, বাইরের মানুষ কলাটা মুলোটা রেখে যেতে পারেন। তালাইয়ের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ‘আন্ডারওয়েট’ শিশুদের একটি তালিকা তৈরি করেছেন। দেখলাম, ২১ জনের মধ্যে ২ জন আন্ডারওয়েট। আমাদের দেশের ৪০ শতাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার। গরিব লোধাদের মধ্যে অপুষ্টির হার অনেক বেশি হতে বাধ্য। বুঝলাম, এই সংখ্যাটি আকস্মিক, যাকে বলে ‘আউটলায়ার’। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী জানালেন, তিনি অপুষ্ট দু’জনের জন্যই স্পেশাল ডায়েটের চেষ্টা করছেন।
জেলা পরিষদের পূর্ত সংক্রান্ত স্থায়ী সমিতির কর্মাধ্যক্ষের সঙ্গে গেলাম দোমোহনী নদীর উপর একটি জলাশয় দেখতে। বেলপাহাড়ির এত কাছে, এত সুন্দর জায়গা আছে আমার জানা ছিল না। বড় দিঘির চারিদিকে জঙ্গল আর ছোট্ট পাহাড়। দূরে দেখা যায় গারাসিনি পাহাড়ের চূড়ায় শিবের মন্দির। ট্রেকিং করে যাওয়াও যায়। ট্রেকিং রুটে আরও দু-একটি মনোরম স্পট ছুঁয়ে যাওয়া যায়। জেলা পরিষদ চান এই জলাশয়ের ধারে একটি ট্যুরিস্ট রিসর্ট গড়তে।
সাঁকরাইল সুপারস্টারস। আদিবাসী মেয়েদের ফুটবল টিম। সাঁকরাইল থানার ওসি’কে যেখান থেকে অপহরণ করেছিল মাওবাদীরা, তার কাছেই ওদের প্র্যাকটিসের মাঠ। মাঠের এক পাশে ক্লাবঘর হয়েছে প্রশাসনের সৌজন্যে। ক্লাবঘরে চেঞ্জিং রুম আছে, টয়লেট আছে। ক্লাবঘরের সামনে লিয়োনেল মেসির বিশালাকার ছবি। অল্প দিনের প্র্যাক্টিসেই এরা সুব্রত কাপে খেলার সুযোগ পেয়েছে। দিল্লি যাওয়ার জোর প্রস্তুতি চলছে। সমস্যাও আছে। ফুটবল খেলা চালিয়ে যেতে হলে পুষ্টির দরকার। মেয়েদের কারও পারিবারিক অবস্থা এমন নয় যে, উচিত মাত্রায় প্রোটিন ইত্যাদির ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সবাই মিলে তাই চেষ্টা করছেন কোনও বাণিজ্যিক সংস্থার সাহায্য পেতে।
প্রশ্ন করতেই পারেন, সবই তো হল, কিন্তু উন্নয়ন হল কোথায়? কতকগুলি পোশাকি, প্রতীকী কাজের কথা না বলে আমাদের কি উচিত ছিল না মাথাপিছু উত্পাদনের কথা দিয়ে শুরু করা? তখন আর এখনের তফাত থেকেই অঙ্ক কষে বার করা যেত কতখানি উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু উন্নয়নের অঙ্ক এত সহজ নয়। যে প্রকল্পগুলির কথা বললাম, সেগুলি সবই রূপায়িত হয়েছে বা হবে সরকারের অনুমোদন নিয়েই। কিন্তু তাদের বিশেষত্ব হল, জেলা স্তরের উদ্যোগের পরিমাণ। বিডিও-কে কেউ নির্দেশ দেয়নি আদিবাসী মেয়েদের ফুটবল শেখাতে। আইসিডিএস সেন্টারগুলি সাজিয়ে তোলার ভাবনা এসেছে অতিরিক্ত জেলাশাসকের বাঁকুড়া জেলার তালডাংরা ব্লকের অভিজ্ঞতা থেকে। সেন্টারগুলির ডিজাইনে সাহায্য করেছেন ঝাড়গ্রামের এসডিও-র বন্ধু। এই উদ্যম যত দিন দেখা যাবে, তত দিন কড়ি গুনবার দরকার হবে না। জনসাধারণ কী ভাবে সাড়া দিলেন, তাই দেখেই বোঝা যাবে প্রকৃত উন্নয়ন হচ্ছে কি না। গতানুগতিক প্রকল্প রূপায়ণে সাড়া মেলে না। তাই অ্যাকাউন্ট্যান্ট ডাকতে হয়।
তার মানে এই নয় যে, উপার্জন বাড়াবার জন্য কোনও চেষ্টা হচ্ছে না। লালগড়ের শালুকায় গিয়েছিলাম স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কাজ দেখতে। অনেক বাড়ির সামনেই তখন শালপাতা শুকোনো হচ্ছে। শালপাতার থালা তৈরি করে একটি পরিবার দিনে ১০০ টাকা রোজগার করত। বন বিভাগ কয়েকটি মেশিন বসিয়েছে, যার ফলে দৈনিক আয় ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। শালুকায় এবং আর একটি গ্রামে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর চেষ্টায় অনেকেই জৈব সার তৈরির ভার্মিকম্পোস্ট পিট করেছেন।
কর্মসংস্থানে এখনকার সবচেয়ে বড় প্রকল্প নিঃসন্দেহে গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনা। পশ্চিম মেদিনীপুরে ২০১২-১৩ সালে যত টাকার কাজ হয়েছিল, এ বছর প্রথম ছ’মাসেই তার বেশি টাকার কাজ হয়েছে। কর্মসংস্থান প্রকল্পের সঙ্গে সেরিকালচার বিভাগের প্রকল্প যুক্ত করে তসরের চাষ হচ্ছিল মারমিসোল আর তেঁতলায়। পোকাগুলি বেশ বড় হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই গুটি তৈরি হবে। এই গুটি ঠিকমত বিক্রি করতে পারলে ১০০ জনেরও বেশি শ্রমিক বছরে ৩০,০০০ টাকা রোজগার করতে পারবেন। সাঁকরাইল ব্লকে এনআরইজিএ স্কিমে কয়েক হাজার পুকুর কাটা বা সংস্কার করা হয়েছিল। মত্স্য বিভাগের সঙ্গে এখন ‘জল ধরো মাছ ভরো’ প্রকল্পে মাছ চাষ হচ্ছে। চাষিদের মাছের চারা, মাছের খবর এবং ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ হলে মাছের উত্পাদন অনেক বাড়বে।
সিএডিসি-র এক পরিত্যক্ত বাগানে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে পুকুর কাটা, হর্টিকালচার, পোলট্রি, মাছ চাষ, নার্সারি হচ্ছে। লোধা সম্প্রদায়ের চাষিদের এই কাজের ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। কয়েকটি ট্যুরিস্ট কটেজও হবে। একই ধরনের কাজ হাতে নেওয়া হচ্ছে ডুলুঙ আর সুবর্ণরেখার মধ্যবর্তী অত্যন্ত উর্বর চর এলাকায়। একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। সেই অনুযায়ী জমি তৈরি হচ্ছে। ফলের গাছ লাগানো হয়েছে অনেক।
আমরা আশির দশকে কর্মসংস্থানের জন্য যা করেছিলাম, তা অবশ্য এঁরা এখন পারবেন না জমি বিলি আর বর্গা নথিভুক্তকরণ। গ্রামোন্নয়নে এই কাজের কোনও বিকল্প নেই। তবে, তিরিশ বছর পরে জঙ্গলমহলে সেই কাজের সীমাবদ্ধতা কিছু জায়গায় চোখে পড়ছে। মনে আছে, গোপীবল্লভপুরে জমি বিলি করতে এসে আমি আর সেট্লমেন্ট অফিসার এক দিন বেশ বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম। সেই অঞ্চলেই কোনও কোনও জায়গায় এখন দেখছি, আশির দশকে পাওয়া জমিতে চাষিরা চাষ করতে পারেননি। মন্টিপা গ্রামে লোধা চাষিদের অবস্থা যেমন। সেখানে একটু জল ছিল বলে একটা ব্যবস্থা করা গিয়েছে। ছোট তার্কি, বড় তার্কিতে অনেক চেষ্টা করেও কিছু করা গেল না। জল নেই, কী চাষ হবে? এই সব দেখেও মাওবাদীরা জোতদার মারতে বলেন! জমি না হয় পাওয়া গেল, জল আসবে কোথা থেকে? ঋণ কে দেবে? সংগ্রামের ক্ষেত্র এখন বিস্তৃত। রাত্রিবেলায় জঙ্গলে গিয়ে বন্দুক চালানো না শিখে পঞ্চায়েত যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে, তা নিলেই বেশি লাভ।
কর্মসংস্থান হতে হবে মূলত কৃষিভিত্তিক। তার জন্য অসংখ্য ছোট ছোট জলাশয়ের সংরক্ষণ করে জলের ব্যবস্থা করতে হবে। এই ধরনের উদ্যোগ কমই নেওয়া হচ্ছে। নিশ্চয়ই কাজ জানা লোকের অভাবে। বৃষ্টির জলের এক ফোঁটাও নষ্ট হয় না এমন খামার আমাদের দেশে অনেক আছে। জঙ্গলমহলেই বা থাকবে না কেন? মাইলের পর মাইল শুধু ধান চাষ হবে কেন? কিছু ডাল চাষ হোক, কিছু তৈলবীজ। কলকাতা শিলিগুড়ির মতো বাজার ক’টা রাজ্যে আছে? এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।
ঝাড়গ্রামে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ফেডারেশনটি চালান মধুমিতা। তিনি অনেক মানুষকে মাশরুম তৈরি করা শিখিয়েছেন। খড়্গপুরে নিয়ে গেলেই মাশরুম ১০০ টাকা কিলোগ্রাম দরে বিক্রি হয়ে যাবে। একই ভাবে মধু তৈরি করতে পারলে কিছু বাড়তি আয় হয়, বাচ্চারাও খেতে পারে। এক কালে সোশ্যাল ফরেস্ট্রির নামে অনেক ইউক্যালিপটাস লাগানো হয়। গাছগুলি এখনও আছে। ইউক্যালিপটাসের মধুর বাজার ভাল।
পাঠিকা ও পাঠক এতক্ষণে বুঝেছেন যে, এই লেখাটি নিছক ভ্রমণকাহিনি। এই লেখায় জঙ্গলমহলের উপর কোনও স্বয়ংসম্পূর্ণ থিসিস পাওয়া যাবে না। কিন্তু, জঙ্গলমহলে যাঁরা বাস করেন, তাঁদের সমস্যার, সুবিধা-অসুবিধার একটা আভাসও কি পাওয়া যাবে না?
(চলবে)
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূতপূর্ব মুখ্যসচিব