সম্পাদকীয় ২

তবুও

২০১৫ সালের রেল বাজেটের মুখবন্ধ হিসাবে কেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর তৃতীয় শ্রেণিতে রেলসফরের প্রসঙ্গ টানিয়া আনিতে হয়, তাহা বোঝা দুষ্কর নহে। কিন্তু, সেই বাধ্যবাধকতা যদি সমগ্র বাজেটের উপর ছায়া ফেলিতে থাকে, তখন সংশয় হয়— সংস্কারের বুলি শুধু কথাতেই থাকিয়া যাইবে না তো? রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু তাঁহার বাজেট ভাষণে বলিলেন, রেলের হাতে থাকা সম্পত্তির বাণিজ্যিক ব্যবহার হইবে, কিন্তু তাহা বিক্রয় করা হইবে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৩
Share:

২০১৫ সালের রেল বাজেটের মুখবন্ধ হিসাবে কেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর তৃতীয় শ্রেণিতে রেলসফরের প্রসঙ্গ টানিয়া আনিতে হয়, তাহা বোঝা দুষ্কর নহে। কিন্তু, সেই বাধ্যবাধকতা যদি সমগ্র বাজেটের উপর ছায়া ফেলিতে থাকে, তখন সংশয় হয়— সংস্কারের বুলি শুধু কথাতেই থাকিয়া যাইবে না তো? রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু তাঁহার বাজেট ভাষণে বলিলেন, রেলের হাতে থাকা সম্পত্তির বাণিজ্যিক ব্যবহার হইবে, কিন্তু তাহা বিক্রয় করা হইবে না। কেন? যে পথে হাঁটিলে রেলের সম্পদের শ্রেষ্ঠ ব্যবহার সম্ভব, সেই পথটি বাছিয়া লওয়াই রেলমন্ত্রীর একমাত্র কর্তব্য। গোড়াতেই ‘বেচিব না’ বলিয়া পথটি মারিয়া রাখিবার মধ্যে প্রাচীন রাষ্ট্রবাদের সুর ধরিয়া রাখা আছে, অর্থনৈতিক বিবেচনা নাই। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র নীতি অনুসরণ করিয়া রেলের নূতন প্রযুক্তির যাবতীয় নির্মাণ ভারতেই হইবে, এমন ঘোষণা লইয়াও প্রশ্ন ওঠে। যদি আমদানি করা অপেক্ষাকৃত লাভজনক হয়, তবে তাহাই কর্তব্য। রেলকে লাভজনক ভাবে, পেশাদার ভঙ্গিতে চালানোই রেলমন্ত্রীর একমাত্র কাজ। দারিদ্র দূরীকরণ, কর্মসংস্থান, ভারতে শিল্পের বিকাশ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, হাসপাতাল পরিচালনা, এগুলি সবই রেলমন্ত্রীর অকর্তব্য। রেল বাজেটে এই বোধের ঘাটতি প্রকট হইয়া থাকিল।

Advertisement

তাহা সত্ত্বেও, বাজেটটি বিভিন্ন কারণে আশাব্যঞ্জক। লালুপ্রসাদ যাদব বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়দের দৌলতে মানুষ ভুলিতে বসিয়াছিলেন যে রেল বাজেট সমগ্র দেশের জন্য, রেলমন্ত্রীর রাজ্যের জন্য নহে। সুরেশ প্রভু কথাটি স্মরণে রাখিয়াছেন। তাঁহার বাজেটে অহেতুক লোক ভুলাইবার প্রচেষ্টা নাই। তবে, তিনি আরও একটু সাহসী হইয়া সাবার্বান ট্রেনের ভাড়া খানিক বাড়াইতে পারিতেন। অন্য দিকে, তিনি যে অপারেটিং রেশিয়ো-র লক্ষ্যমাত্রা স্থির করিয়াছেন, সেই ৮৮.৫% সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানের নিরিখে প্রায় অকল্পনীয়। ডিজেলের দাম কমায় তিনি যে সুবিধা পাইয়াছেন, তাহার যথার্থ ব্যবহারের ইঙ্গিত রহিয়াছে। বস্তুত, স্মরণকালের মধ্যে ইহাই প্রথম রেল বাজেট, যাহাতে একটি পথনির্দেশিকা তৈরির প্রয়াস রহিয়াছে। আগামী পাঁচ বৎসর তিনি কী করিতে চাহেন, এবং তাহার জন্য কী করা প্রয়োজন, রেলমন্ত্রী তাহা স্পষ্ট জানাইয়াছেন। পূর্বতন জমানার যাহা কিছু, সবই মুছিয়া ফের চাকা আবিষ্কারের পরিচিত এবং বিপজ্জনক পথে তিনি হাঁটেন নাই। বরং, প্রথমে জমিয়া থাকা প্রকল্পগুলি শেষ করিবার যে নীতি সদানন্দ গৌড়া ঘোষণা করিয়াছিলেন, সুরেশ প্রভু তাহা বজায় রাখিয়াছেন। রেল বাজেটকে রাজনীতি হইতে বাঁচাইয়া রাখিবার এই প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। রাজ্য সরকারগুলির সহিত যৌথ উদ্যোগের ভাবনাটিও অভিনব।

কিন্তু, রাজনীতিকে না ডরাইয়াও বুঝি মন্ত্রিবরের উপায় নাই। তাহার জন্য যেমন রেলের সম্পদ না বেচিবার আবেগঘন প্রতিশ্রুতি দিতে হয়, তেমনই বেসরকারি বিনিয়োগের প্রসঙ্গটি অতি সাবধানে লুকাইয়া রাখিতে হয়। বাজেট ভাষণে বেশ কয়েক বার বেসরকারি বিনিয়োগের কথা আসিল, কিন্তু প্রতি বারই রেলমন্ত্রী প্রসঙ্গটিকে ছুঁইয়াই প্রসঙ্গান্তরে চলিয়া গেলেন। এত ভয় কীসের? খুলিয়া বলুন, ভারতীয় রেলে যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন, তাহার জন্য বেসরকারি ক্ষেত্রের— দেশি এবং বিদেশি, উভয় গোত্রেরই— দ্বারস্থ হইতে হইবে। সেই বিনিয়োগের জন্য দরজা খোলাই কর্তব্য। রাজনীতিকরা যত দিন না কথাটি নির্দ্বিধায় বলিতে পারেন, তত দিন প্রকৃত সংস্কার অধরাই থাকিবে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement