বিশ্ববিদ্যালয়ের যথেষ্ট স্বশাসনের অধিকার নাই? বেশ তো, স্বশাসন সম্পূর্ণ কাড়িয়া লইবার ব্যবস্থা করিতেছি।—পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী মুখ ফুটিয়া এমন কথা বলেন নাই বটে, কিন্তু কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাপরম্পরা দেখিয়া মনে করিবার কারণ আছে, তাঁহাদের মনের কথাটি এইরূপই। পরম্পরাটি অর্থবহ। দ্বারভাঙা ভবন হইতে সুরঞ্জন দাস বিদায় লইতেছেন, তাহা বড় কথা নহে, সেই বিদায় পূর্বনির্ধারিত ছিল। কিন্তু গত কয়েক দিনে তিনি যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হইয়াছেন, তাহা এই বিদায়কে এক ভিন্ন মাত্রা দিয়াছে। ইহাকে সসম্মান প্রস্থান বলা কঠিন। উপাচার্য তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসম্মানের মূলে রহিয়াছে রাজ্য সরকার তথা শাসক দলের অনৈতিক প্রভুত্ব, দলীয় ‘ছাত্রনেতা’দের অশালীন তাণ্ডব যে প্রভুত্ব হইতে রসদ সংগ্রহ করিয়াছে। কিন্তু সুরঞ্জনবাবুর আসনটি আপাতত যে ভাবে পূরণের বন্দোবস্ত হইয়াছে, তাহা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনের অনুকূল নহে। সুরঞ্জন দাসের মতোই, সুগত মারজিৎ গবেষক ও শিক্ষক হিসাবে অকিঞ্চিৎকর নহেন, কিন্তু সরকার ও শাসক দলের সহিত তাঁহার সমীকরণ এবং গত কয়েক বছরে বিভিন্ন পরিসরে, বিশেষত উচ্চশিক্ষা সংসদের প্রধান হিসাবে তাঁহার কর্মপদ্ধতি দেখাইয়া দিয়াছে যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বশাসন খর্ব করিয়া তাহাদের উপর কর্তৃত্ব কায়েম করিতেই তিনি অতিমাত্রায় আগ্রহী ও তৎপর। আশঙ্কা স্বাভাবিক যে, ‘শৃঙ্খলা’ প্রতিষ্ঠার নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বক্ষমতা হরণের সেই স্বভাবসিদ্ধ কার্যক্রমটি এ বার কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও চালু হইবে, এবং এই কারণেই তাঁহাকে অন্তর্বর্তী উপাচার্যের পদে বসাইবার পরিকল্পনাটি রচিত। এই নিয়োগ শাসকদের, আক্ষরিক অর্থেই, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
এই সূত্রেই দুইটি নীতি স্পষ্ট করা আবশ্যক। এক, অন্তর্বর্তী উপাচার্যকে বাহির হইতে আনিবার নিয়মটি ভুল। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্ণধারের আসন সহসা শূন্য হইলে সাময়িক ভাবে কাজ চালাইবার জন্য সচরাচর প্রতিষ্ঠানের ভিতর হইতেই উপযুক্ত ব্যক্তিকে খুঁজিয়া লওয়া হয়। তাহাতে ধারাবাহিকতা বজায় থাকে, পদ্ধতিটিও শোভন হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও তাহাই স্বাভাবিক রীতি। যোগ্য ব্যক্তি কে, তাহা নির্ধারণের কাজটিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আধিকারিকদেরই এক্তিয়ারে থাকা বিধেয়, সরকারের কোনও ভূমিকা থাকা কাম্য নহে। কিন্তু এ রাজ্যে বারংবার ইহার অন্যথা দেখা গিয়াছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী উপাচার্যের পদে বসানো হইয়াছে ‘বহিরাগত’দের, অনেক ক্ষেত্রে তাঁহারাই স্থায়ী হইয়াছেন। শাসক রাজনীতিকরা এই ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর নিজেদের দখল কায়েম করিয়াছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিজিৎ চক্রবর্তী স্বনামধন্য হইয়াছেন, কিন্তু তিনিই এই দখল অভিযানের একমাত্র নিদর্শন নহেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও সম্ভবত সেই ‘অন্তর্বর্তী উপাচার্য’ অভিযানের শিকার।
দ্বিতীয় কথা: অন্তর্বর্তী উপাচার্য নামক ব্যবস্থাটিই অনাবশ্যক। প্রথমত, সাধারণত বর্তমান উপাচার্যের কার্যকালে যথেষ্ট সময় থাকিতেই উত্তরসূরি নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি সারিয়া ফেলা উচিত, একান্ত আকস্মিক কারণ ভিন্ন অন্তর্বর্তী নিয়োগের কোনও প্রয়োজন হইবার কথাই নহে। ব্যতিক্রমকে নিয়মে পরিণত করিলে বেনিয়ম এবং অস্থিরতা প্রশ্রয় পায়, পশ্চিমবঙ্গে ঠিক তাহাই হইতেছে। দ্বিতীয়ত, উপাচার্যের পদটিকে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির তুল্য মনে করিবার বিশেষ কোনও কারণ নাই, ব্যতিক্রমী কারণে সেই পদ কিছু দিন শূন্য থাকিলেই বা ক্ষতি কী? আইনে আটকাইতে পারে, কিন্তু সদিচ্ছা থাকিলে আইন পরিবর্তন করাও সম্ভব। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় যাঁহাদের নিকট নিতান্তই রাজনৈতিক সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রকরণ, তাঁহারা তেমন সদিচ্ছা পোষণ করিবেন কোন দুঃখে?