গত শতাব্দীর শেষ দিকে আফগানিস্তানে বামিয়ান বুদ্ধের মূর্তি বিস্ফোরক সংযোগে ধ্বংস করিয়া তালিবান জঙ্গিরা প্রমাণ করিয়াছিল, তাহাদের ইসলামি জেহাদের সহিত সভ্যতা-সংস্কৃতির কোনও যোগ নাই, বরং মানবসভ্যতার সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধ্বংস করিয়াই তাহাদের বর্বরতা অগ্রসর হইতে পারে। একবিংশ শতক ইরাক ও সিরিয়ায় তাহাদের সুযোগ্য উত্তরসূরি খুঁজিয়া পাইয়াছে ইসলামিক স্টেট-এর সন্ত্রাসবাদীদের মধ্যে, যাহারা নাকি একটি খিলাফত স্থাপন করিয়াছে। অতঃপর এই জেহাদিরা অন্য ধর্মাবলম্বীদের (যথা কপটিক খ্রিস্টান) কিংবা স্বধর্মেরই অন্য সম্প্রদায়ের (যথা শিয়া, ইয়াজিদি, আহমদিয়া) রক্তে নিজেদের ধর্মীয় হাত রঞ্জিত করার পর মসুল ও নিনেভের জাদুঘরের দিকে হাত বাড়াইয়াছে। সেখানে সঞ্চিত খ্রিস্টপূর্বাব্দের সব অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, মূর্তি হাতুড়ি কিংবা ইলেক্ট্রিক ড্রিল দিয়া ভাঙিয়া টুকরো করা হইতেছে। তালিবানদের মতোই ইসলামি রাষ্ট্রবাদীদের অপকাণ্ডের যুক্তিও একই— পৌত্তলিক সভ্যতার নিদর্শন, দেবদেবীর মূর্তি ধ্বংস করিয়া তাহারা ধর্মের নির্দেশ পালন করিতেছে।
আসিরীয়, পারসিক, ব্যবলিনীয় সভ্যতার মহান ঐতিহ্য ধ্বংস করার পক্ষে এই বর্বর অশিক্ষিতের যুক্তি জেহাদিদের কাছে যথেষ্ট মনে হইয়াছে। প্রথমে তাহারা কালোবাজারে প্রত্নসামগ্রীগুলি বেচিয়া আগ্নেয়াস্ত্র কেনার অর্থ সংগ্রহ করিয়াছে। এক্ষণে মসুলের জাদুঘরে ঢুকিয়া হাতুড়ি দিয়া সপ্তম খ্রিস্টপূর্বাব্দের আসিরীয় দেবদেবীর মূর্তি ভাঙিতেছে। গত মাসে এই মসুলেরই সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে তাহারা দুই হাজার বিরল পুথি ও পাণ্ডুলিপির বহ্ন্যুৎসব করিয়াছে। স্পষ্টতই, এই বর্বর নরপিশাচরা ধর্মের নামে আসলে নিজেদের সংকীর্ণ কায়েমি স্বার্থ ও মতলব হাসিল করিয়া চলিয়াছে। ২০০৩ সালেও ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনে বাগদাদের যে দিন পতন হয়, এপ্রিল মাসের সেই দিনটিতেও লুঠেরাদের দেখা গিয়াছিল বাগদাদের জাতীয় মিউজিয়ামে ঢুকিয়া লুঠপাট ও ভাঙচুর চালাইতে। ভাঙচুরে লিপ্ত না হইলেও মার্কিন সেনাদের একাংশ মূল্যবান প্রত্ননিদর্শন লুণ্ঠনে হাত লাগাইয়াছিল। ওই চোরচূড়ামণি ও লুণ্ঠনকারীদের সপক্ষে অন্তত এটুকু বলা যায় যে, তাহারা ঐতিহ্যপূর্ণ নিদর্শনগুলি নষ্ট করে নাই, চড়া দরে বিক্রয় করিয়া কয়েক প্রজন্ম বসিয়া খাওয়ার ব্যবস্থা করিয়াছিল।
তবে আফগানিস্তানের মতো ইরাক ও সিরিয়াতেও কিন্তু যুদ্ধ, আগ্রাসন, উপপ্লবই সেই দুর্যোগ, যাহা কেবল সংশ্লিষ্ট জাতির ক্ষেত্রে নয়, সমগ্র মানবপ্রজাতির জন্যই অবক্ষয়, নৈরাজ্য ও ধ্বংসের আয়োজন সম্পূর্ণ করিয়াছে। আজ আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইরাক ও সিরিয়ায় যে কোনও দুষ্কৃতী-দমনকারী শক্ত প্রশাসন নাই, তাহার দায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পাশ্চাত্য গণতন্ত্র এড়াইতে পারে না। কোথাও গণতন্ত্র আনার ছলে, কোথাও রাসায়নিক মারণাস্ত্র মজুত থাকার ভুয়া অভিযোগে, কোথাও রুশ আগ্রাসন ঠেকাইবার অজুহাতে পশ্চিমী গণতন্ত্রই এই মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে নৈরাজ্য ও জেহাদের শক্তিকে অর্গলমুক্ত করিয়াছে। সাদ্দাম হুসেন, মোয়াম্মার গদ্দাফি, বাশার-আল-আসাদ কিংবা আফগান প্রেসিডেন্টকে অপসারিত করিয়া সেখানে ওয়াহাবি জেহাদ ও সালাফি উগ্রপন্থার উত্থানের পথ প্রশস্ত করিয়াছে পশ্চিমী গণতন্ত্রই। আজ আসিরিয়া-ব্যবলিনের প্রত্ন-ইতিহাস ধ্বংসের দায়ভাগ তাহারা অস্বীকার করিতে পারে না।