পশ্চিমবঙ্গে শারদোৎসবের চেহারা চরিত্র কালক্রমে কী ভাবে বদলাইয়াছে, সেই বিষয়ে বিস্তর আলোচনা শোনা যায়। তাহার অধিকাংশই অতীতচারী হা-হুতাশ হইলেও মূল্যবান সামাজিক বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ দুর্লভ নয়। কিন্তু এই উৎসবের অর্থনীতি সম্পর্কিত আলোচনা নিতান্ত বিরল। বাঙালির চরিত্রে তাহা হয়তো স্বাভাবিক, কারণ অর্থনীতি অতি বিশুষ্ক বিষয় হিসাবেই কুখ্যাত এবং ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় বহু দশক আগেই রায় দিয়াছেন: বিশুদ্ধ জ্ঞানের চর্চায় বাঙালির মতি নাই। তদুপরি অর্থনীতির অন্য নাম ‘বিষাদ-বিজ্ঞান’, উৎসব খুঁড়িয়া কে-ই বা বেদনা জাগাইতে ভালবাসে? কিন্তু দুর্গাপূজার অর্থনৈতিক ইতিহাস বাঙালি সমাজের বিবর্তনের চরিত্র বুঝিবার পক্ষে বিশেষ উপযোগী। সেই ইতিহাস রচনা বিশেষজ্ঞের কাজ। আপাতত, মহাসপ্তমীর প্রভাতে উৎসবযাপনের প্রস্তুতি শুরুর পূর্বে তাহার একটি বিশেষ দিক লক্ষণীয়।
এই উৎসব কাহার উৎসব? শহরের দুর্গোৎসব এক সময় বারো(ই)য়ারি হইতে সর্বজনীন হইয়াছে। নামের এই বিবর্তনে বাংলার পুরসমাজের একটি ইতিহাস নিহিত ছিল। বিভিন্ন পল্লিতে কয়েক জন সমর্থ ও সম্পন্ন উদ্যোগীর উৎসব হইতে সেই অঞ্চলের সমস্ত পুরজনের উৎসবে রূপান্তরিত হইবার মধ্যে একটি উত্তরণের প্রয়াস ছিল। সামাজিকতার উত্তরণ। সেই সামাজিকতার বীজমন্ত্র: ‘এই পুজো আমাদের সকলের’। মন্ত্র বাস্তব নহে, কোনও দিনই সর্বজনীন দুর্গোৎসবগুলি সত্য অর্থে সর্বজনের উৎসব হইয়া উঠে নাই। সমাজ এবং অর্থনীতির অন্তর্নিহিত বহুমাত্রিক বৈষম্যগুলি তাহাদের অবয়বে ও মেজাজে প্রতিফলিত হইয়াছে। অর্থকৌলীন্যের জোরে বিভিন্ন সর্বজনীন উৎসবের উপর স্থানীয় কিছু মানুষ প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করিয়াছেন, ক্রমশ তাহার সহিত যুক্ত হইয়াছে রাজনৈতিক প্রতিপত্তি, রাজনীতির দাপট এবং টাকার জোর একত্র হইয়া সামাজিক ক্ষমতার নূতন সমীকরণ তৈয়ারি হইয়াছে। সর্বজন-এর ভূমিকা বার্ষিক চাঁদা দেওয়ার কর্তব্যেই সীমিত থাকিয়াছে, সেই কর্তব্যও এক সময় অত্যাচারে পরিণত হইয়াছে— স্থানীয় আধিপত্যের অত্যাচার।
ইতিহাস জঙ্গম। গত দুই দশকে কলিকাতার, এবং ক্রমশ বিভিন্ন ছোট শহরের, দুর্গোৎসবের অর্থনীতিতে পরিবর্তন ঘটিয়াছে। ‘স্পনসর’ শব্দটি দেখিতে দেখিতে তাহাকে আপাদমস্তক গ্রাস করিয়াছে। বহু গৃহস্থের পক্ষে তাহা মঙ্গলজনক, কারণ চাঁদার উৎপাত কমিয়াছে। কিন্তু এই বিবর্তনের ফলে শারদোৎসব পরিণত হইয়াছে কার্যত এক একটি ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে। এবং পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে গত কিছু বছরে রকমারি আলো-আঁধারি (এবং সম্পূর্ণ তমসাচ্ছন্ন) আর্থিক কারবারের অমোঘ প্রভাব পড়িয়াছে উৎসবের কাঠামোতেও, এই কারবারিদের অর্থ যেমন বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োজিত হইয়াছে, তেমনই উৎসবের আয়োজনেও। সারদা কেলেঙ্কারির টানে সেই কারবারে ধস নামিবার প্রতিক্রিয়া ঘটিয়াছে শারদোৎসবের পরিসরেও। অনেক পূজার উদ্যোক্তারা বিপাকে পড়িয়াছেন, অনেক পূজা কার্যত অথবা বস্তুত বন্ধ হইয়া গিয়াছে। নূতন জমানায় শাসক দলের বিবিধ রাজনীতিকের সহিত বিবিধ ‘বড় পূজা’র সরাসরি সংযোগ এবং তাহার পাশাপাশি রাজনীতি ও আর্থিক ‘লগ্নি’ কারবারের নিবিড় যোগাযোগ— দুইয়ের যৌথ ক্রিয়ায় এই মুহূর্তে উৎসবের অর্থনীতিতে এক ধরনের মন্থন চলিতেছে। আপাতত সেই মন্থনে গরল উঠিবে, তাহাই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি এই বিপর্যয়ের পরে উৎসবের অর্থনীতি বদলায়, যদি পূজার আয়োজন ‘স্পনসর’-এর দাসত্ব ছাড়িয়া আবার যথার্থ সর্বজনীন উদ্যোগের পথে অগ্রসর হয়, তবে সামাজিকতার নূতন উত্তরণ ঘটিবে। শুনিলে নিতান্ত দুরাশা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তবু, ধন্য আশা কুহকিনী।