চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ মানিয়া কেন্দ্রীয় সরকার জানাইয়াছে, কর রাজস্বে রাজ্যগুলির ভাগ ৩২ শতাংশ হইতে বাড়িয়া ৪২ শতাংশ হইবে। কেন্দ্রীয় সরকার প্রবল, রাজ্য সরকার দুর্বল— ইহা ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ত্রুটি। সেই প্রেক্ষিতে রাজস্ব বণ্টনে রাজ্যের বাড়তি বরাদ্দ স্বাগত। কিন্তু প্রথমত, অনুপাতটি অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ হইলে কেন্দ্র-রাজ্যের গুরুত্বে প্রাথমিক সমতা প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে। সেই সাম্য এখনও দূর অস্ত্। দ্বিতীয়ত, কেবল রাজস্ব বণ্টনে রাজ্যের ভাগ বাড়িলেই যুক্তরাষ্ট্রের সম্মান সুরক্ষিত হয় না, আর্থিক ক্ষমতার অন্য নানা ক্ষেত্রেও সমতা প্রতিষ্ঠা জরুরি। অর্থ কমিশনের দিশা অনুসরণ করিয়া সেই বৃহত্তর সমতার দিকে অগ্রসর হওয়া কেন্দ্রের দায়িত্ব। রাজস্বের বাড়তি ভাগ পাইয়া রাজ্য সরকারগুলি কৃতার্থ বোধ না করিয়া নীতি আয়োগ বা অন্য মঞ্চে কেন্দ্রের নিকট মৌলিক সংস্কারের দাবি পেশ করিবে, ইহাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা।
অর্থ কমিশনের সুপারিশ পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে অন্য কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। এই সুপারিশের ফলে বাড়তি রাজস্ব এবং অনুদান হিসাবে আগামী অর্থবর্ষে অমিত মিত্র প্রায় কুড়ি হাজার কোটি টাকা বেশি পাইবেন। সুসংবাদ। তবে ভয়ানক সুসংবাদ। রাজ্যের হাতে বাড়তি টাকা এবং ক্ষমতা আসিলে রাজ্যবাসীর খুশি হইবার কথা। কিন্তু, এই রাজ্যের নাম পশ্চিমবঙ্গ, যাহার প্রশাসনিক কেন্দ্রের সর্বোচ্চ তলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধিষ্ঠান। তিনি অর্থনীতির যুক্তির তোয়াক্কা করেন না। সহজ পথে মানুষের মন ভুলাইবার জন্য যাহা প্রয়োজন, তিনি সবেতেই রাজি। তিনি করের হার বাড়াইতে অসম্মত, ‘ইউজার চার্জ’ আদায়ে তাঁহার প্রবল অরুচি। রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের অনুপাতে কর আদায়ের পরিমাণে পশ্চিমবঙ্গ গোটা দেশে একেবারে পিছনের সারিতে পড়িয়া থাকে, অর্থমন্ত্রীকে ঋণের ঝুলি লইয়া বাহির হইতে হয়। এমন মুখ্যমন্ত্রীর হাতে হঠাৎ কুড়ি হাজার কোটি টাকা বাড়তি আসিলে— তাহাও আবার বিধানসভা নির্বাচনের মুখে, নির্বাচনী দানসত্রের বহর কী ভাবে বাড়িতে পারে, ভাবিয়া দুশ্চিন্তা হওয়াই স্বাভাবিক। রাজ্যে কোনও প্রকৃত বিচক্ষণ শাসক থাকিলে তিনি বর্তমান প্রাপ্তিকে ভবিষ্যতের কাজে লাগাইতেন। অবিলম্বে রাজকোষ ঘাটতি কমাইবার কাজে মন দিতেন। রাজস্ব বাড়াইবার চেষ্টা করিতেন। রাজ্যে বিনিয়োগের, কর্মসংস্থানের পরিবেশ তৈরি করিতে উদ্যোগী হইতেন। যুক্তরাষ্ট্রীয়তার যে পথে ভারত হাঁটিতেছে, তাহাতে ইহাই একমাত্র কর্তব্য। আর কেন্দ্রের মুখাপেক্ষী হইয়া বাঁচিবার উপায় নাই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সে কথা বুঝিবেন, এমন ভরসা কে করিবে?
এই পরিপ্রেক্ষিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎপ্রার্থী হইবারও বিশেষ তাৎপর্য আছে। রাজ্যের ঋণ মকুবের জন্য দরবার করিতেই তিনি নরেন্দ্র মোদীর সময় চাহিয়াছেন। যে প্রধানমন্ত্রীর একাধিক আহ্বান তিনি ফিরাইয়া দিয়াছেন, এমনকী নীতি আয়োগের প্রথম সভায় দেশের একমাত্র অনুপস্থিত মুখ্যমন্ত্রীর শিরোপা অর্জন করিয়াছেন, এমনকী যাঁহার বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধঘোষণা করিতেও দ্বিধা বোধ করেন নাই, তাঁহার নিকট সহসা সহযোগিতার আবেদন জানাইবার এই সিদ্ধান্ত চমকপ্রদ। কিন্তু যদি ইহা যুদ্ধং দেহি মনোভাব ছাড়িয়া আলাপ আলোচনার পথে ফিরিবার সংকেত হয়, তাহা অভিনন্দনযোগ্য। বোধোদয় বিলম্বিত হইলেও স্বাগত। ভয় অন্যত্র। অধমর্ণের ঋণ মকুবের অনুরোধ মেটানো কঠিন কাজ— অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের পক্ষেও, নরেন্দ্র মোদীর পক্ষেও। সুতরাং, সেই অনুরোধ পূর্ণ হইল না বলিয়া মুখ্যমন্ত্রী যদি ‘কেন্দ্রের বঞ্চনা’ লইয়া নূতন শোরগোল তুলিয়া আপন সরকারের ব্যয়সংকোচের দায়িত্ব এড়াইয়া চলিতে থাকেন, পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে তাহার পরিণতি অশুভ হইতে বাধ্য।