স্থান, কাল, পাত্র আলাদা। পরিণাম এক। প্রতিবাদের শাস্তিতে প্রহার ও মৃত্যু। কোথাও প্রতিবাদীরা মদ-জুয়ার ঠেক চালাইবার বিরুদ্ধে মুখ খুলিয়াছেন, তো কোথাও নারী-নিগ্রহের বিরুদ্ধে। কখনও উত্তর চব্বিশ পরগনার বামনগাছি, কখনও হাওড়ার সালকিয়া, আবার কখনও জলপাইগুড়ির মালকানি হাট। প্রতিবাদীরা কোথাও সদ্য-যুবক, কোথাও বা মাঝবয়সী। দুষ্কৃতীরা সর্ব ক্ষেত্রেই প্রতিবাদীদের হত্যা করিতেছে। ছুরি, ক্ষুর, লোহার রড, এমনকী থান-ইট দিয়া থ্যাঁতলাইয়া মারার ঘটনাও আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রক্তাক্ত অবস্থায় পথে পড়িয়া থাকা প্রতিবাদীর যন্ত্রণাক্ত দেহ স্থানীয় প্রতিবেশীরা হাসপাতালে লইতেছেন, যাওয়ার পথে কিংবা যাওয়ার পরই তাঁহাদের মর্মান্তিক মৃত্যু। পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের নিরাপত্তা বহু কালই লুপ্ত, পুরুষ সঙ্গী ছাড়া তাঁহাদের পথে বাহির হওয়া দিবাভাগেও ঝুঁকির ব্যাপার। উপরন্তু অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত দুষ্কৃতীরা এত বাড়িয়াছে যে, অপকর্মের যে কোনও প্রতিবাদই তাহারা নির্মম ভাবে দমন করিতেছে।
এই দুঃশাসনের প্রেক্ষিতটি সহজবোধ্য। পুলিশ নিজে হইতে দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার করিবে, সে দিন গত। কারণ পুলিশ এখন দুষ্কৃতীদের ভয় পায়। দল-আশ্রিত দুর্বৃত্তদের ভয়ে কখনও তাহারা থানার ভিতরেই টেবিলের তলায় ফাইলের আড়ালে লুকাইয়া পড়ে। আর দলীয় ভৈরবরা কাউন্সিলর, পঞ্চায়েত সদস্য কিংবা স্থানীয় দলনেতার নেতৃত্বে একের পর এক থানায় হামলা করে, পুলিশকে পর্যন্ত শারীরিক নিগ্রহ করে, বন্দি দুষ্কৃতীকে থানা হইতে ছিনাইয়া লয়, প্রশাসনের কর্তা ও কর্ত্রীরা অন্য দিকে চাহিয়া থাকেন। পুলিশ নিজেই রক্ষণাত্মক ভূমিকায়, তাই অসামাজিক ক্রিয়াকলাপের প্রতিবাদীদের নিরাপত্তা দিতে অক্ষম। শীর্ষ আধিকারিকরা পর্যন্ত এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের ‘কথা শুনিয়া থাকেন’, ‘অভিযুক্তরা পলাতক’ কিংবা ‘গোটা ঘটনার তদন্ত চলিতেছে’ ইত্যাদি বলিয়া দায় সারেন। ফলে অভিযুক্তরা কখনওই ধরা পড়ে না, ধরা পড়ার ভয়ে গুটাইয়াও থাকে না, এলাকায় বুক ফুলাইয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। স্বাভাবিক পরিণতি।
যে নিষ্ঠুরতার সহিত প্রতিবাদীদের মারা হইতেছে, তাহাতে সমাজের অন্তর্লীন হিংস্রতা লইয়াও ভাবিবার প্রয়োজন আছে। এই হিংস্রতা অতীতেও দেখা গিয়াছে, তবে তাহা প্রধানত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কেন্দ্র করিয়াই। সেখানে যুযুধান উভয় পক্ষেই যূথবদ্ধ হিংসায় লিপ্ত হওয়ার তাগিদ থাকিয়াছে। এখন কিন্তু সেই অর্থে শাসক দলের কোনও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীও নাই। তা ছাড়া, দুষ্কৃতীরা তো ঝান্ডাবাহী হইলেও সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী নহে। তাহাদের তরফে প্রতিবাদীর উপর চড়াও হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার তাগিদও অনুপস্থিত। তথাপি প্রতিবাদীদের কণ্ঠরোধ করিতে তাহারা বাড়তি নির্মমতার আশ্রয় লইতেছে। যেখানে কেবল ভয় দেখাইলেই প্রতিবাদীদের বৃহদংশ নিষ্ক্রিয় হইয়া পড়েন, সেখানে রাস্তায় ফেলিয়া ইটের ঘায়ে তাঁহাদের থ্যাঁতলাইয়া মারার দরকার কী? সেটা কি দৃষ্টান্ত স্থাপনের তাগিদে, যাহাতে ভবিষ্যতে আর কেহ তাহাদের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহস না দেখায়। তাহার পরেও প্রতিবাদীরা আপন নৈতিকতার প্রেরণায় রুখিয়া দাঁড়াইতেছেন, হয়তো দাঁড়াইবেনও। কিন্তু তাঁহাদের পাশে দাঁড়াইবার ন্যূনতম চেষ্টাও কি পুলিশ প্রশাসন করিবে না?