সম্পাদকীয় ১

ব্যর্থতার সন্ধানে

পাকিস্তান যদি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হয়, পশ্চিমবঙ্গও ‘ব্যর্থ রাজ্য’ শিরোপাটির প্রবল দাবিদার। পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় শাসন বহু ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত, কিংবা অকার্যকর, কিংবা অপ্রাসঙ্গিক। পশ্চিমবঙ্গও তথৈবচ। এ রাজ্যের অভ্যন্তরে আইনের শাসন আছে, এমন কথা অতি বড় তৃণমূল কংগ্রেসিও অন্তর হইতে বলিতে পারিবেন না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০১
Share:

পাকিস্তান যদি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হয়, পশ্চিমবঙ্গও ‘ব্যর্থ রাজ্য’ শিরোপাটির প্রবল দাবিদার। পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় শাসন বহু ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত, কিংবা অকার্যকর, কিংবা অপ্রাসঙ্গিক। পশ্চিমবঙ্গও তথৈবচ। এ রাজ্যের অভ্যন্তরে আইনের শাসন আছে, এমন কথা অতি বড় তৃণমূল কংগ্রেসিও অন্তর হইতে বলিতে পারিবেন না। তাঁহারাও জানেন, শাসন এক প্রকার আছে বটে, কিন্তু তাহা আইনের নহে, বরং বিভিন্ন প্রতাপশালী ব্যক্তির, যাঁহাদের অঙ্গুলিশাসনে পুলিশ-প্রশাসন উঠে এবং বসে। তন্ত্র আছে, কিন্তু তাহা দলীয় প্রতাপের নিরঙ্কুশ তন্ত্র। আইনশৃঙ্খলা যাঁহাদের প্রাত্যহিক দায়, সকলের মধ্যেই ব্যাপক ত্রাস, মাথার উপরের নেতা-নেত্রীরা কখন কোন পথে তাঁহাদের উপর চড়াও হন। সুষ্ঠু গণপরিষেবা বলিয়া বস্তুটি গোটা রাজ্যব্যাপী উধাও। সর্বত্রবিহারী সরকারি অকর্মণ্যতার অবকাশে নানা পদ্ধতিতে অর্থাদায়ের হিড়িক পড়িয়াছে, যাহার শুদ্ধ প্রতিশব্দ, তোলাবাজি। আপাতত রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ যে অতলান্ত অন্ধকারের অভিমুখে অভূতপূর্ব দ্রুততায় ধাবিত হইতেছে, বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলনের আলোকসজ্জায় তাহা ঢাকা পড়িবে না।

Advertisement

এই অন্ধকারকে সম্পূর্ণ নূতন বলা চলে না। গত দশকেও দেখা গিয়াছে কী ভাবে বাম শাসনের আপাত-স্থিতির অন্দরে স্তরে স্তরে ঘুণ ধরিয়াছে। কিন্তু গত সাড়ে তিন বৎসরে এই সাধনায় যে সাফল্য সম্ভব হইয়াছে, তাহা, এক কথায়, অভাবিত। নৈরাজ্যে এই গভীরতা ও ব্যাপকতা পশ্চিমবঙ্গ কেন, উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের মতো দুই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া ভারতের অন্য কোনও রাজ্যই দেখিয়াছে কি না সন্দেহ। থানার পুলিশ জনগণের ভয়ে ঠকঠক করিয়া কাঁপিতেছেন, দরজা জানালা বন্ধ করিয়া টেবিলের তলায় লুকাইতেছেন। কলিকাতা হইতে মফস্সল সর্বত্র কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে হুমকি, লাঠালাঠি, হানাহানির বন্যা বহিতেছে। উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তি কোনও নেতার অবমাননা করিয়াছেন বলিয়া সর্বসমক্ষে গণপিটুনিতে তাঁহার প্রাণসংশয় ঘটানো হইতেছে। ধর্ষণ কিংবা পিটুনি-খুন, কোনও অপরাধই শাস্তিযোগ্য, এমনকী গ্রেফতারযোগ্য বলিয়া বিবেচিত হইতেছে না। দুর্নীতির দায়ে শাসকরা ধরা পড়িতেছেন, তাঁহাদের ছাড়াইতে ক্ষমতান্ধ নেতাদের পরিচালনায় দলোন্মত্ত জনতার স্রোত বহিতেছে। সমতুল্য পরিস্থিতির জন্যই সাউথ সুদান, উগান্ডা বা সিরিয়ার মতো দেশের কপালে ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা জুটিয়াছে। প্রবীণ বাঙালি বিজ্ঞানী বাংলার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগাতার আন্দোলনের প্রকোপ দেখিয়া গভীর বিষাদে রাজ্যকে ‘ব্যর্থ’ বলিয়াছেন। কেবল শিক্ষাক্ষেত্রে নয়, সর্বক্ষেত্রে তাণ্ডবচর্চা তাঁহার অভিধাকরণকে দুই শত ভাগ সঙ্গত প্রমাণ করে।

‘ব্যর্থতা’ কাহাকে বলে, এই তাত্ত্বিক প্রশ্ন উঠিতে পারে। উত্তর সহজ। ব্যর্থতার কোনও মানদণ্ডই বিজ্ঞানভিত্তিক নহে। এই মানদণ্ড অবশ্যই পর্যবেক্ষণ-ভিত্তিক, ব্যক্তিসাপেক্ষ, এবং তদনুযায়ী, তর্কসাপেক্ষও নিশ্চয়। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানে তো যে কোনও সাফল্য-ব্যর্থতার মাত্রাই আপেক্ষিক, ইতিহাসেও। মার্কিন ভাষাতাত্ত্বিক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক নোম চমস্কি যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যর্থ রাষ্ট্র আখ্যা দেন, তখন তিনিও তাঁহার আপেক্ষিক অবস্থান হইতেই তাঁহার বিতর্কযোগ্য দর্শন নির্মাণ করেন। বিতর্ক স্বাগত, বিতর্ক চলুক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বিতর্কের কেন্দ্রটি গুণগত নয়, পরিমাণগত। গণতন্ত্রের মানদণ্ড অর্থাৎ আইন, শৃঙ্খলা ও সমদর্শিতার মান্য নীতি অনুসারে পশ্চিমবঙ্গ ‘সাফল্য’ না ‘ব্যর্থতা’ কোন তলে বিচরণ করিতেছে, ইহা কোনও প্রশ্ন নহে। প্রশ্ন কেবল, ব্যর্থতার কোন ধাপটিতে এ রাজ্যের বিচরণ, তাহা যথাযথ নির্ধারণ। এই বিতর্কের নিষ্পত্তি করিতে পশ্চিমবঙ্গের সোমালিয়ায় পরিণত হইবার জন্য অপেক্ষার প্রয়োজন নাই।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement