সম্পাদকীয় ২

বাহিরে নহে

দ্বিতীয় চিন হইয়া উঠিবার প্রতিজ্ঞাটি যে ভারতকে বিপাকে ফেলিতে পারে, কথাটি স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজন। তাঁহার সতর্কবার্তাটিকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া বিধেয়। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পূর্বাভাস তিনিই দিয়াছিলেন। নরেন্দ্র মোদীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ রাজনের চোখে বিপজ্জনক ঠেকিয়াছে। কারণটি সরল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share:

দ্বিতীয় চিন হইয়া উঠিবার প্রতিজ্ঞাটি যে ভারতকে বিপাকে ফেলিতে পারে, কথাটি স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজন। তাঁহার সতর্কবার্তাটিকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া বিধেয়। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পূর্বাভাস তিনিই দিয়াছিলেন। নরেন্দ্র মোদীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ রাজনের চোখে বিপজ্জনক ঠেকিয়াছে। কারণটি সরল। বিশ্ব অর্থনীতি এখন যে অবস্থায় আছে, তাহাতে আরও একটি দেশের প্রভূত রফতানি হজম করিবার মতো সামর্থ্য তাহার নাই। রফতানি-নির্ভর আর্থিক বৃদ্ধির খেলাটি যেহেতু চিন বহু কাল খেলিতেছে, অতএব সে ময়দানে ভারত ঢুকিতে চাহিলে খেলাটি কাহার পক্ষে কঠিন হইবে, অনুমান করিতে রাজনের সমতুল্য আর্থিক প্রজ্ঞার প্রয়োজন নাই। কাজেই চিন বা পূর্ব এশিয়ার ‘ব্যাঘ্র অর্থনীতি’গুলি যে পথে সমৃদ্ধি অর্জন করিয়াছে, সেই পথ ভারতের নহে। কোনও একটি বিশেষ ক্ষেত্রের উপর অতি-নির্ভরশীল হওয়াও নহে। চিনের বৃদ্ধি মূলত নির্মাণশিল্প-নির্ভর ছিল। কিন্তু, ভারতের চরিত্র পৃথক, সময়ও পৃথক। কাজেই, চিনে যে ঔষধ ধরিয়াছে, ভারতে তাহার সাফল্যের নিশ্চয়তা নাই। রাজন, তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ অনুচ্চকিত ভঙ্গিতে বলিয়াছেন, ভারতে কোন ক্ষেত্রটি বৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি হইয়া উঠিবে, তাহা কেহ জানে না। কাজেই, সব দিকে নজর রাখাই বিধেয়।

Advertisement

কোন পথে ভারত আর্থিক বৃদ্ধির সাধনা করিতে পারে, রাজন তাহাও বলিয়াছেন। তাহা ‘মেক ফর ইন্ডিয়া’-র পথে। ভারতে নির্মাণ নহে, ভারতের জন্য নির্মাণ। রফতানি নহে, অভ্যন্তরীণ বাজারের উপর জোর দেওয়া। স্মরণ রাখা বিধেয় যে ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দার ধাক্কা ভারতে তেমন তীব্র ভাবে না লাগিবার প্রধান দুইটি কারণ হইল যথাক্রম ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারের ক্রয়ক্ষমতা ও রফতানির উপর অপেক্ষাকৃত কম নির্ভরশীলতা। প্রশ্নটি বিশ্ববাজারের ছোঁয়াচ এড়াইয়া ইন্দিরা গাঁধীর আমলের কূপমণ্ডূকতার নহে, প্রশ্ন বিচক্ষণতার। এক্ষণে বিশ্ববাজার তাহার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতাকে আশ্রয় দেওয়ার অবস্থায় নাই। সেই বাস্তবটি মাথায় রাখিয়াই চলিতে হইবে। রাজন বলিয়াছেন, তাহার জন্য অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের হার বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব দিতে হইবে। তদনুকূল রাজস্ব নীতি প্রয়োজন। বল অরুণ জেটলির কোর্টে।

রফতানির উপর জোর বাড়াইবার নীতির একটি অনুষঙ্গ আমদানি-প্রতিস্থাপন। নেহরু যুগের কোনও একটি আর্থিক নীতি যদি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত প্রমাণিত হইয়া থাকে, তবে তাহা এইটি। বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতা হইতে বাঁচিতে আমদানি শুল্কের পিছনে লুকাইয়া পড়িবার অভ্যাসটি ভারতের শিল্পমহলের যত ক্ষতি করিয়াছে, আর কিছু ততখানি পারে নাই। নরেন্দ্র মোদীর সরকার যাহাতে সেই ফাঁদে পা না দেয়, তাহার জন্য সতর্ক থাকিতে হইবে। প্রবণতা কিন্তু দেখা যাইতেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার তথ্যপ্রযুক্তি চুক্তি তাহার উদাহরণ। চিন ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতানৈক্যে চুক্তিটির নূতন দফা আপাতত আটকাইয়া গিয়াছে। ভারত এই চুক্তির আলোচনায় যোগ দেয় নাই। চুক্তিটি আজ না হউক কাল হইবেই। বহু নূতন প্রযুক্তিনির্ভর ইলেকট্রনিক পণ্যের উপর শুল্কও কমাইতেই হইবে। ভারতীয় নির্মাতাদের এই বাজারেই লড়িতে হইবে। কাজেই, তাহাদের প্রস্তুত করাই বিধেয়। চুক্তি হইতে মুখ লুকাইবার কৌশলটি অবিলম্বে পরিত্যাজ্য। প্রতিযোগিতার যোগ্য হইয়া উঠিতে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হওয়াই বিধেয়। দরজা আঁটিয়া তলোয়ার চালানো অভ্যাস করিয়া যুদ্ধ জয় করা অসম্ভব।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন