সম্পাদকীয় ১

বহুরূপে সম্মুখে সবার

পশ্চিমবঙ্গে গ্রাম দখলের রাজনীতি কেন সমস্ত ‘পরিবর্তন’কে অতিক্রম করিয়া বহাল, জনসমর্থন কেন এমন বিদ্যুদ্গতিতে সিপিআইএম, তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি’র মধ্যে চালাচালি হইতেছে, রাতারাতি পতাকার রং এবং মুখোশের ঢং বদলাইয়া যাইতেছে, অমর্ত্য সেনের ‘আইডেনটিটি’ বা পরিচিতি বিষয়ক ভাবনার মধ্যে সেই রহস্যের সূত্র দিব্য নিহিত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১
Share:

পশ্চিমবঙ্গে গ্রাম দখলের রাজনীতি কেন সমস্ত ‘পরিবর্তন’কে অতিক্রম করিয়া বহাল, জনসমর্থন কেন এমন বিদ্যুদ্গতিতে সিপিআইএম, তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি’র মধ্যে চালাচালি হইতেছে, রাতারাতি পতাকার রং এবং মুখোশের ঢং বদলাইয়া যাইতেছে, অমর্ত্য সেনের ‘আইডেনটিটি’ বা পরিচিতি বিষয়ক ভাবনার মধ্যে সেই রহস্যের সূত্র দিব্য নিহিত। অধ্যাপক সেন জোর দিয়াছেন পরিচিতির বহুত্বের উপর। চল্লিশের দশকের বাংলা হইতে নব্বইয়ের দশকের রোয়ান্ডা হিংস্রতার বিভিন্ন কাহিনিতে তিনি লক্ষ করিয়াছেন মানুষকে একক পরিচিতিতে আবদ্ধ করিবার ‘সলিটারিস্ট’ বা ‘একমাত্রিক’ ধারণা। হিন্দু বনাম মুসলমান কিংবা হুটু বনাম টুটসি এক একটি সংকীর্ণ এবং একক পরিচিতির খোপে বাঁধা গোষ্ঠীর ভয়াবহ সংঘাতের বিভিন্ন রূপমাত্র। এই একমাত্রিকতার ছকে বঙ্গীয় রাজনীতিকে দেখিলে সত্যই বিস্ময়ের অন্ত থাকে না: গত কাল যে সিপিআইএম ছিল, আজ সে কী করিয়া বিজেপি হয়, কে তৃণমূল, কে বিজেপি, কে সিপিআইএম, তাহা লইয়া এমন ভয়ানক বিভ্রান্তিই বা তৈয়ারি হয় কী ভাবে? অধিকন্তু, যে বিজেপি’র সংসর্গ মুসলমান সমাজের নিকট বিষবৎ বলিয়া জানা ছিল, মুসলমানপ্রধান অঞ্চলে তাহারা এমন সমর্থন কোথা হইতে সংগ্রহ করিয়া ফেলে যে, তাহাদের প্রসার রোধে শাসক দলের বাহিনীকে ময়দানে নামিতে হয়?

Advertisement

একমাত্রিক ছকটি ছাড়িয়া পরিচিতির বহুত্ব খেয়াল করিলেই বিস্ময় কাটিয়া যাইবে, সত্য উন্মোচিত হইবে। সত্য ইহাই যে, দলীয় বা জাতিগত বা ধর্মীয় পরিচিতিই একমাত্র পরিচিতি নহে। পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে, শাসকদের দৌরাত্ম্যের ফলে বহু নাগরিকের নিকট অন্য একটি পরিচিতি প্রায়শই গুরুতর আকার ধারণ করে। তাহাকে বলা চলে ‘অত্যাচারিত’ পরিচিতি। ইহা সিপিআইএম দুঃশাসনেও দেখা গিয়াছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুঃশাসনেও প্রকট। যাঁহারা শাসক দল বা তাহার ক্ষমতাশালী উপগোষ্ঠীর অত্যাচারে সন্ত্রস্ত, তাঁহারা আশ্রয় খুঁজিতেছেন, ‘প্রধান বিরোধী দল’ সিপিআইএম সেই আশ্রয় দিতে ব্যর্থ, কারণ তাহারা ক্ষমতা হারাইবার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত গতিতে আপন প্রাসঙ্গিকতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা হারাইয়াছে, ভেনেজুয়েলার রাজনীতির ভবিষ্যৎ এবং ১৯৭৮ সালের পার্টি দলিলের অতীত লইয়া সর্বদা চিন্তিত থাকিলে এমনটাই হওয়ার কথা। রাহুল গাঁধীর দলটির কথা আলোচনায় আসে না। বাকি রহিল বিজেপি। নানা কারণে এখন তাহার প্রতিপত্তি প্রবল, বিশেষত দিল্লির গদিতে তাহার শক্তিমান প্রধানমন্ত্রী, সন্ত্রস্ত মানুষ অন্তত আপাতত এই দলের উপর ভরসা করিতেছেন। সেই ভরসায় তাঁহাদের হিন্দুত্ব বা মুসলমানত্বের কিছুমাত্র ভূমিকা নাই। তাঁহারা অত্যাচারিত, এই পরিচিতিই এ ক্ষেত্রে একমাত্র প্রাসঙ্গিক।

এই বহুত্ব হইতে ভারতীয় জনতা পার্টিরও শিখিবার আছে। আজ তাহাদের বাজার-দর ঊর্ধ্বগামী, রাজ্যে রাজ্যে তাহাদের ভোটের শতাংশ বাড়িতেছে। কিন্তু এখনও এই দলের বহুত্ববাদী ভাবমূর্তি উজ্জ্বল নহে, বিশেষত সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্বে তাহারা নিতান্ত পশ্চাৎপদ, সংসদ বা মন্ত্রিসভায় চোখ বুলাইলেও তাহা স্পষ্ট। যদি জাতীয় রাজনীতিতে যথার্থ নেতৃত্বের ভূমিকা লইতে চাহেন, তবে নরেন্দ্র মোদী এবং সহনায়কদের এই দুর্বলতা মোচন করিতে হইবে। পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতা সংকেত দিতেছে, তাহার সুযোগ আছে, সংখ্যালঘুরা ধর্মীয় পরিচিতির একক পরিসর ছাড়িয়া বৃহত্তর সত্তায় নিজেদের দেখিতে প্রস্তুত, বস্তুত আগ্রহী। কিন্তু এই আগ্রহকে সম্মান করিতে চাহিলে বিজেপিকেও আপন পরিচিতিকে একমাত্রিকতা হইতে মুক্তি দিতে হইবে। নরেন্দ্র মোদী অমর্ত্য সেনের অর্থনীতি না পড়িতে পারেন, তাঁহার ‘আইডেনটিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স’ বইখানি পড়িলে উপকার পাইবেন।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন