বাংলা প্রাপ্তমনস্ক গোয়েন্দাকাহিনির ধারাটিকে কে খুন করল? এই প্রশ্নটা নতুন করে উঠল ব্রাত্য বসুর সাম্প্রতিক নাটক ‘কে?’ দেখতে গিয়ে। এ নাটকের মঞ্চে মজাদার সাসপেন্স, চাঁছাছোলা অপশব্দ। কিন্তু সে সবের আয়ু ওই দু’ঘণ্টা। যবনিকা পতনের পরও বেঁচে যে চরিত্রটি, সে গোয়েন্দা চটক চট্টরাজ।
নাটকে চটকের স্যাটেলাইট পিট্টু বলছে, ‘গোয়েন্দা চটক চট্টরাজ এক জন রক্ষণশীল ক্লাসিক্যাল গোয়েন্দা। মিস্টার চট্টরাজ কোনও ছিঁচকে কেস নেন না। ছিঁচকে মানে, মানসিক ভাবে ছিঁচকে। এমনকী গরু বা লাউচুরির মতো ফালতু কেসও মিস্টার চট্টরাজ নিতে রাজি আছেন, কিন্তু ধরুন কোনও স্বামী বা স্ত্রীর হয়ে বেটার হাফকে ফলো করা, তাদের মোবাইল ফোনে আড়ি পাতা, তৃতীয় কোনও নারী বা পুরুষের বাড়ির সামনে ঘাপটি মেরে বসে থেকে মশার কামড় খাওয়া ইত্যাদি ঘিনঘিনে ব্যাপারে চটক চট্টরাজকে আপনারা পাবেন না।’
এই ‘মানসিক ভাবে ছিঁচকে’ কথাটা ভেবে দেখার মতো। বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা বলতে এখন ওই দুটো শব্দই মনে হয়। ফেলুদা-ব্যোমকেশের মৃত্যু ঘটেছে, পরাশর বর্মা বা হুকাকাশিও অন্তর্ধান করেছেন, বাঙালির গোয়েন্দাপ্রেম এখন কেবল পুরনো গল্পের সিনেমায়নে। গত দু’দশকেরও বেশি সময় জুড়ে এমন একটি গোয়েন্দার নামও করা যাবে না যাঁর নতুন কীর্তির অপেক্ষায় থাকতে হয়!
এর কারণ কী? বেশির ভাগ গোয়েন্দাকে শেষ পর্যন্ত শিশুতোষ হতে হয়, শিশুপাঠ্য কাহিনিতেই মুখ ঢেকে থাকতে হয়? ফেলুদা প্রাপ্তবয়স্করাও উপভোগ করেন বটে, কিন্তু সে আসলে বড়বেলায় লুকিয়ে থাকা ছোটবেলাটাকেই তোল্লাই দেওয়া। আর, ব্যোমকেশকে যতই প্রাপ্তবয়স্কের গোয়েন্দা বলার চেষ্টা হোক, দু’একটি ব্যতিক্রম বাদে মূলত তা নিতান্ত নিরামিষ, সর্বজনপাঠ্য।
অথচ বাংলা সাহিত্যেই একটা সময় ছিল যখন বাঙালির গোয়েন্দা বেশ জমজমাট ছিল। ছোটদের কথা ভেবে সে সব কাহিনি লেখাই হত না। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের দারোগার দপ্তর ছিল, কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের বাঁকাউল্লার দপ্তর ছিল, পাঁচকড়ি দে-র বিদেশি ছায়াচ্ছন্ন গোবিন্দরাম, দেবেন্দ্রবিজয়, অরিন্দম বসু ছিল। আর ছিল দীনেন্দ্রকুমার রায়ের বিদেশি বাঙালি রবার্ট ব্লেক, স্মিথ। এঁদের গল্পের সমস্যা ছিল একটাই, ভাষা, রচনারীতি। শরদিন্দুর কলম এঁরা কেউ পাননি, নইলে জমিয়ে দেওয়ার মতো গল্পের অভাব এঁদের ছিল না।
আসলে প্রিয়নাথের দারোগা কিংবা কালীপ্রসন্নের বাঁকাউল্লা পুলিশের গোয়েন্দাগিরির কাহিনি। প্রিয়নাথ ছিলেন সরকারি গোয়েন্দা দফতরের চাকুরে, বাঁকাউল্লাও তাই। বাংলা গোয়েন্দাকাহিনির ইতিহাস লিখতে গিয়ে সুকুমার সেন দেখিয়েছিলেন, যথার্থ ডিটেকটিভ কাহিনি পুলিশি-ব্যবস্থা প্রচলনের পরেই লেখা হয়। কিন্তু ক্রমে বেসরকারি গোয়েন্দাকে সর্বজ্ঞ আর পুলিশকে নিতান্ত অজ্ঞ করে দেখানোর একটা ছক চালু হল, হয়তো শার্লক হোমসের অনুকরণেই। সেই ছক কেটে বাংলা গোয়েন্দা কাহিনি কোনও দিনই বেরিয়ে আসতে পারল না। বাস্তবের পুলিশও হয়তো তার একটা বড় কারণ। আর এই ভাবে চেনা ছকে বার বার খেলতে গিয়ে বাংলার গোয়েন্দা সাহিত্য ক্রমে ‘মানসিক ভাবে ছিঁচকে’ হয়ে উঠলেও দু’এক জন সেলিব্রিটির বাইরে বাকি সবাইকে আমরা বটতলা-র বই বা পপুলার ফিকশন-এর ছাপ মেরে দিয়েছি। অথচ, ভাষা এবং উপস্থাপন যতই সেকেলে হোক, বাঙালির প্রাপ্তমনস্ক গোয়েন্দাকাহিনির সম্বল ও সম্ভাবনা ছিল সেখানেই।
জি ডব্লিউ এস রেনল্ডস নামে এক ব্রিটিশ সাংবাদিক-লেখকের গোয়েন্দা কাহিনি একদা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তাঁর বইয়ের অনেকগুলি ভারতীয় সংস্করণ বেরোত এবং হু হু করে বিকোতও। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, সে যুগের ইয়ং বেঙ্গলদের বইয়ের তাকে টম পেন-এর এজ অব রিজন এবং বায়রনের কবিতার পাশে রেনল্ডসের মিস্ট্রিজ অব লন্ডন দিব্য শোভা পেত। কিন্তু রেনল্ডস-অনুপ্রাণিত আমাদের ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের হরিদাসের গুপ্তকথা-র কথা ভাবুন। সে বই নিতান্ত নিষিদ্ধ, অপাঠ্য। অথচ সে কালে প্রায় তিন দশক জুড়ে হু হু করে বিক্রি তার, শরৎচন্দ্র থেকে প্রমথ চৌধুরী তাতে মজেছিলেন সকলেই, কিন্তু নিষিদ্ধ মার্কাটা ঘোচেনি আর। বইয়ের তাকে নয়, শোওয়ার ঘরের বালিশের নীচে মলাট দিয়ে সে বই রাখতে হয়, তরুণ মজুমদারের ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ সিনেমার সেই দৃশ্যটার কথা ভাবুন এক বার!
গোয়েন্দা গল্পকে আমরা যতই বিশেষ ভাবে শ্রীমানদের জন্য লিখতে শুরু করলাম ততই সেগুলি প্রায় ছেলেভুলোনো ছড়ার সমগোত্রীয় হয়ে পড়ল। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে হেমেন্দ্রকুমার রায় এবং মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের হাতে এই কৈশোরক ধারাটির শুরু। তা ক্রমে জোলো হতে হতে আজ কেবল কয়েকটি কিশোর পত্রিকার পাতা ভরানোর সাহিত্যে এসে ঠেকেছে। এই দুর্ভাগ্য কাটাতে একটা কথা হয়তো ভেবে দেখা যায় এ বার। বরং বটতলা-র মার্কামারা বইগুলোকেই নতুন করে পরিশীলিত ভাষায় লেখা হোক না। সেটাও এক জনে না পারিলে দেখি বারো জনে, বারোয়ারি উপন্যাসের মতো? সুকুমার সেন প্রতিষ্ঠিত ‘হোমসিয়ানা ক্লাব’ থেকে তেমন একটা চেষ্টা এক বার হয়েওছিল তো, পাঞ্চজন্য-এ।
সত্যিই যদি এমনটা হয় তাহলে হয়তো ব্রাত্য-র নাটকের অরুণের মতো আরও অনেককে গোয়েন্দার খিদে মেটাতে আর ‘ক্ষুধার্ত খোক্কস’ পড়তে হবে না।