সম্পাদকীয় ১

ভূতই ভবিষ্যৎ

কর আদায়ের অধিকার সম্পূর্ণ কেন্দ্রায়িত হইবে, আর ব্যয়ভার নির্বাহের ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণ, এমন ব্যবস্থাকে যুক্তরাষ্ট্রীয়তার পরাকাষ্ঠা বলিয়া মানিয়া লওয়া দুষ্কর। অরুণ জেটলির বাজেট ভাষণে স্পষ্ট, কেন্দ্রীয় সরকার এই পথেই হাঁটিতেছে। তিনি জানাইয়াছেন, আগামী বৎসর এপ্রিল হইতে পণ্য ও পরিষেবা কর (গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স, সংক্ষেপে জিএসটি) চালু হইতেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৫ ০০:০১
Share:

কর আদায়ের অধিকার সম্পূর্ণ কেন্দ্রায়িত হইবে, আর ব্যয়ভার নির্বাহের ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণ, এমন ব্যবস্থাকে যুক্তরাষ্ট্রীয়তার পরাকাষ্ঠা বলিয়া মানিয়া লওয়া দুষ্কর। অরুণ জেটলির বাজেট ভাষণে স্পষ্ট, কেন্দ্রীয় সরকার এই পথেই হাঁটিতেছে। তিনি জানাইয়াছেন, আগামী বৎসর এপ্রিল হইতে পণ্য ও পরিষেবা কর (গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স, সংক্ষেপে জিএসটি) চালু হইতেছে। অতঃপর, কোন পণ্যে কতখানি কর আদায় করা হইবে, স্থির করিবার সম্পূর্ণ অধিকার কেন্দ্রীয় সরকারের। অন্য দিকে, বহু কেন্দ্রীয় প্রকল্পে দিল্লি আর টাকা দিবে না। প্রকল্পগুলি চালাইতে হইলে তাহার দায়িত্ব রাজ্য সরকারকে লইতে হইবে। ব্যবস্থাটি বিচিত্র হইল। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য মানিতে চাহিবেন না। বলিবেন, রাজস্বে রাজ্যগুলির হিস্সা এক ধাক্কায় দশ শতাংশ-বিন্দু বাড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। বাজেট ভাষণে অর্থমন্ত্রী শুনাইয়া দিয়াছেন, ইহার পূর্বে কখনও রাজ্যের হাতে এত টাকা ছিল না। তাহা হইলে আর সমস্যা কী? সমস্যা দুই গোত্রের। গৌণ সমস্যা হইল, অর্থমন্ত্রী যে হিসাব পেশ করিয়াছেন, তাহাতে ফাঁকফোকরের সংখ্যা কিঞ্চিৎ বেশি। আর মুখ্য সমস্যা হইল, যুক্তরাষ্ট্রীয়তার দার্শনিক সংজ্ঞাটি কেন্দ্রীয় সরকার আত্মস্থ করিতে পারে নাই। অথবা চাহে নাই।

Advertisement

২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে কেন্দ্র হইতে রাজস্ব খাতে রাজ্যগুলি মোট ৮,৪২,৯৬৩ কোটি টাকা (মোট কেন্দ্রীয় রাজস্বের ৫৮.২ শতাংশ) পাইবে বলিয়া বাজেটে ধার্য করা হইয়াছে। গত বাজেটে অঙ্কটি ছিল ৭,৭৮,৯৬৬ কোটি টাকা (মোট রাজস্বের ৫৭.১ শতাংশ)। অর্থমন্ত্রী বলিতে পারেন, গত বৎসর কেন্দ্র রাজ্যগুলিকে প্রতিশ্রুত অর্থের ঢের কম দিয়াছিল, ফলে এই বাজেটে বৃদ্ধির পরিমাণ প্রকৃতপ্রস্তাবে বেশি। কিন্তু, এই বৎসর তিনি কথা রাখিবেন, তাহার নিশ্চয়তা কী? অন্য দিকে, কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলিকে তিনটি ভাগে ভাঙা হইয়াছে। প্রথম ভাগের প্রকল্পগুলিতে কেন্দ্র পূর্ববৎ খরচ করিবে। দ্বিতীয় ভাগে খরচের দায়িত্ব কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়েরই, কিন্তু কেন্দ্রের ব্যয়বরাদ্দ ক্রমে কমিবে। আর তৃতীয় ভাগে কেন্দ্রের কোনও দায়িত্ব থাকিল না। প্রকল্প চালাইতে হইলে রাজ্য সরকারকে গাঁটের কড়ি খরচ করিতে হইবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগের ক্ষেত্রগুলিতে এই অর্থবর্ষে রাজ্যগুলির মোট ব্যয় হইবে ৬৬,২২৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ, অরুণ জেটলি রাজস্ব খাতে বাড়তি ৬৩,৯৯৭ কোটি টাকা দিয়া কেন্দ্রীয় প্রকল্পে তাহার অধিক কাটিয়া লইলেন। রাজ্যগুলির অতিরিক্ত খরচ ২,২২৬ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী ইহাকেই আর্থিক যুক্তরাষ্ট্রীয়তায় রাজ্যগুলির ক্ষমতায়নের পথে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বলিয়া দাবি করিবেন?

কেন্দ্র কত টাকা দিল, তাহাতে রাজ্যগুলির কত ক্ষতি হইল, এগুলি তবুও গৌণ হিসাব। প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক রাশটি কেন্দ্রের হাতে থাকিতে পারে না। কেন্দ্রকে এমন অহেতুক গুরুত্ব দেওয়া নেহরু যুগের প্রধানতম ভুল। হয়তো নূতন দেশের পক্ষে কিছুটা স্বাভাবিক ও অনিবার্য ভুল। নরেন্দ্র মোদী যোজনা কমিশনকে বিদায় করিলেন, কিন্তু এই ভুলটি আঁকড়াইয়া থাকিলেন কেন? প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রে উত্তীর্ণ হইতে গেলে ভারতের রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাইতে হইবে। শুধু কর আদায় নহে, সর্ব ক্ষেত্রেই প্রাথমিক অধিকারটি স্বাভাবিক ভাবে রাজ্যের হাতে থাকিবে। রাজ্যগুলি প্রয়োজনে কেন্দ্রকে অর্থসাহায্য করিবে। প্রতিরক্ষা, বিদেশ নীতি, জলবণ্টন বা পরিবেশ আদি কিছু ক্ষেত্রে কেন্দ্র সিদ্ধান্ত লইবার অধিকারী হইবে, কারণ বিষয়গুলি রাজ্যের ভৌগোলিক গণ্ডিতে আবদ্ধ নহে। কিন্তু অন্য সকল ক্ষেত্রে রাজ্যের অধিকার স্বীকার করা কর্তব্য। তাহার জন্য সংবিধান বদলাইবার প্রয়োজন হইলে সেই পথে হাঁটিতে হইবে। কেন্দ্র অভিভাবক-সুলভ বদান্যতায় রাজ্যগুলির হাতখরচের পরিমাণ খানিক বাড়াইয়া দিবে, ইহা যুক্তরাষ্ট্রীয়তা নহে। ইহা নেহরু যুগের ভূত।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন