রবীন্দ্রনাথ যে ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের জন্যও গান লিখিয়া গিয়াছিলেন, তাহা কে জানিত? বোর্ড তাহার সদ্য-অভিষিক্ত কর্ণধার শ্রীযুক্ত জগমোহন ডালমিয়ার উদ্দেশে স্বচ্ছন্দে গাহিতে পারে: তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ। জগমোহন ডালমিয়া ২০০৬ সালে এই একই পদ হইতে বিদায় লইয়াছিলেন। সম্মানজনক পরিস্থিতিতে বিদায় লইয়াছিলেন, তাহা বলা চলে না। কিন্তু সে প্রশ্ন থাকুক। ঘটনা ইহাই যে, তিনি আবার পুরানো আসনে অধিষ্ঠিত হইলেন। ইতিমধ্যে তাঁহার বয়স আরও এক দশক বাড়িয়াছে। এই এক দশকে তিনি যে শারীরিক ভাবে সতেজ সবল সচল হইয়া উঠিয়াছেন তাহা বলিবার উপায় নাই। জরা এবং ব্যাধি কাহারও কথা শোনে না, পদমর্যাদার তোয়াক্কা করে না। শরীর এবং মনের সম্পর্ক কতখানি গভীর, পতঞ্জলি হইতে সোক্রাতেস সকলেই তাহা মূঢ়জনের কান কামড়াইয়া বলিয়া গিয়াছেন। পুরাতনকে বিদায় দিয়া নূতনকে বরণ করিবার উপদেশও বহুশ্রুত, সবুজের অভিযান করিতে একা রবীন্দ্রনাথ বলেন নাই। কে শোনে? অন্তত ভারত নামক প্রবীণতন্ত্রের মহাতীর্থে পুরাতন কিছুতেই বিদায় লয় না এবং যদি বা লয়, তাহার স্থলে পুরাতনতর আসিয়া বসে। সুতরাং শ্রীনিবাসনের আসনে ডালমিয়ার অধিষ্ঠান ভারতীয় ঐতিহ্যের মোক্ষম অভিজ্ঞান।
অথচ ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডে এখন নূতন রক্তের প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি। যে ঘটনাপরম্পরার মধ্য দিয়া শ্রীনিবাসন বোর্ড সভাপতির পদ হইতে বিদায় লইয়াছেন, বস্তুত বিদায় লইতে বাধ্য হইয়াছেন, তাহা কেবল কলঙ্কিত ইতিবৃত্ত নহে, গভীর উদ্বেগের কারণ। আইপিএল-এর বিপুল অর্থের কারবারে ঠিক কতটা দুর্নীতি হইয়াছে, সেই দুর্নীতিতে কাহার দায়ভাগ কতখানি, শ্রীনিবাসন ও তাঁহার অনুগামীরা আপন পদ এবং প্রভাব কী ভাবে কতটা অপব্যবহার করিয়াছেন, তাহা লইয়া তর্ক থাকিতে পারে এবং রকমারি ‘তদন্ত কমিটি’র অনুসন্ধানের পরেও সেই তর্ক অমীমাংসিত থাকিতে পারে, কিন্তু বোর্ডের প্রতিটি কর্মকর্তা মর্মে মর্মে জানেন যে, তাঁহাদের প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি দেশ ও দুনিয়ার চোখে সম্পূর্ণ তমসাবৃত। শ্রীনিবাসনের আচরণ সেই তমসা দূর করিতে সাহায্য করে নাই। আইপিএল কেলেঙ্কারির একেবারে সূচনাপর্বে নৈতিক দায়িত্ব স্বীকার করিয়া তাঁহার সরিয়া যাওয়া কর্তব্য ছিল, অথচ সর্বোচ্চ আদালতের বারংবার তিরস্কার সত্ত্বেও তিনি গদি আঁকড়াইয়া এবং অবশেষে বুড়ি ছুঁইয়া থাকিতে চাহিয়াছেন, শেষ পর্যন্ত আদালতকে কার্যত তাঁহাকে অপসারণ করিতে হইয়াছে। ইহার পরে অন্তত একটি নির্মম শল্যচিকিৎসার আশা জাগিয়াছিল।
তাহা দুরাশা প্রমাণিত। বোর্ডের নূতন কর্মকর্তারা যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হইয়াছেন, তাহা সেই প্রাচীন পরিচিত ‘লবি’র খেলা। অন্তরাল হইতে বিবিধ ক্ষমতাগোষ্ঠীর অঙ্গুলিহেলনে যে ভাবে বিসিসিআইয়ের ‘সরকার’ গঠন হইয়া থাকে, সেই সম্পূর্ণ ক্রিকেটবহির্ভূত প্যাঁচপয়জার আবারও দেখা গেল। এবং তাহার পরিণামে যে কর্মসমিতি তৈয়ারি হইলেও তাহার বিচার বিশ্লেষণেও কে কোন লবির লোক, সেই পুরানো কাসুন্দি ঘাঁটিবার লীলাই অব্যাহত। অর্থাৎ, যত বদলায়, তত বদলায় না। কী পশ্চিমবঙ্গে, কী ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডে। ইহা দুর্ভাগ্যজনক। একটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান আপন আচরণে ও কার্যকলাপে স্বশাসনের মর্যাদা রক্ষা করিবে, ইহা কেবল প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে নহে, সমাজের পক্ষেই গুরুত্বপূর্ণ। নূতন পরিচালকদের সম্মুখে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের সুযোগ আছে। কিন্তু এই অচলায়তনের শীর্ষাসনে বসিয়া জগমোহন ডালমিয়া প্রতিষ্ঠানের ক্লেদ এবং মেদ দূর করিয়া তাহাকে একটি যথার্থ সংস্কৃত রূপ দিবেন, এমন ভরসা করিতে পারিলে নাগরিকরা খুশি হইতেন।