রাজ্য সরকারি অফিসাররা কি ক্রমে উঠিতেছেন, জাগিতেছেন এবং আপন প্রাপ্য মর্যাদা বুঝিয়া লইতে চাহিতেছেন? ইস্পাত কাঠামোর কি আত্মবিস্মৃতি হইতে মুক্তি মিলিতেছে? লয়েড জর্জ যখন ভারতের আমলাতন্ত্রকে ‘স্টিল ফ্রেম’ বলেন, তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী সেই ইস্পাতকঠিন কাঠামোটিকে ঔপনিবেশিক শাসনের সুযোগ্য ভিত্তি হিসাবেই দেখিয়াছিলেন। কিন্তু ইস্পাত কাঠামো ক্রমশ চারিত্রিক দৃঢ়তার প্রতীক হিসাবে স্বীকৃতি আদায় করিয়াছে। সম্মান এবং সমীহও। কারণ: প্রশাসনের পরিচালকদের দৃঢ় মেরুদণ্ডের ভরসা পাইলে মানুষ আশ্বস্ত বোধ করেন— প্রকৃষ্ট শাসনের আশ্বাস। ‘কড়া অফিসার’ কথাটির মাহাত্ম্য এখানেই। পশ্চিমবঙ্গের সচিবালয়ে ও সংশ্লিষ্ট মহলে প্রধান আধিকারিকদের মধ্যে সেই মেরুদণ্ডের অনটন দীর্ঘদিন চলিয়া আসিতেছিল। বামফ্রন্ট সরকার তথা সিপিআইএম-এর সর্বগ্রাসী আনুগত্যতন্ত্রের প্রথম ও প্রধান শিকার হয় আমলাতন্ত্র। দীর্ঘ চৌত্রিশ বছরের শাসনে আনুগত্য ক্রমে মজ্জাগত হয়। শিরদাঁড়া নমনীয় হইয়া পড়ে। অতঃপর ঐতিহাসিক (অ)পরিবর্তন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বভাবত সর্বাধিনায়িকা। ইচ্ছাময়ীর রাজত্বে দলতন্ত্র কথাটি অর্থহীন হইয়াছে, ইহা একতন্ত্র। প্রশাসনযন্ত্র নমনীয় মেরুদণ্ড লইয়া তাহার নিকট সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে ও ‘যথা আজ্ঞা’ বলিতে অভ্যস্ত হয়। ইহাই চলিতেছিল।
আশা জাগিয়াছে, হয়তো আর চলিবে না। আপাতত আশার অঙ্কুরটুকু দৃশ্যমান। একাধিক দফতর হইতে একাধিক আধিকারিকের আচরণে ‘যথা আজ্ঞা’র অভ্যাস ভাঙিয়া ‘মাফ করিবেন’ বলিবার অভ্যাসে ফিরিবার লক্ষণ দেখা যাইতেছে। অতীতে ইহা বিরল ছিল না, মন্ত্রীরা অন্যায় করিতে বলিলে অফিসাররা সবিনয় দৃঢ়তায় জানাইতেন, ‘আইন ভাঙা সম্ভব নহে’ অথবা ‘লিখিত নির্দেশ ভিন্ন এ কাজ করিব না’। সেই সুলক্ষণ ইতস্তত ফিরিতেছে। অভিযোগ উঠিয়াছে যে, টেন্ডার বাছাইয়ের বিধি ভাঙিয়া বিশেষ উমেদারকে বরাত দেওয়ার নির্দেশ দেন স্বয়ং অর্থমন্ত্রী; দরপত্র খুলিবার আগেই বিশেষ সংস্থাকে কাজ দেওয়ার জন্য তথ্য সংস্কৃতি দফতরে ‘উপরমহল’ হইতে চাপ আসে; আইনের তোয়াক্কা না করিয়া সাংস্কৃতিক উত্সবে অংশগ্রাহী গোষ্ঠীকে আগাম টাকা দেওয়ার অনুরোধ তথা আদেশ করেন মন্ত্রী ও শাসক দলের সাংসদ। পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক চাপ যিনিই দিন, সেই চাপের প্রকৃত উত্স কোন শীর্ষাসনে, তাহা সর্বজনবিদিত। কিন্তু সংশ্লিষ্ট অফিসাররা ইহাতেও নতিস্বীকার করেন নাই, ফলে অন্যায় আদেশের বাহকরা পিছু হটিয়াছেন। অর্থমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে ডাকিয়া অভিযোগ উড়াইবার চেষ্টা করিয়াছেন, কিন্তু দৃশ্যত তাঁহার ফুত্কারে জোর নাই, অভিযোগ মোটেও উড়ে নাই, সংশয় ঘনীভূত হইয়াছে।
অন্যায় নির্দেশ না মানিবার এই দৃঢ়তা এই রাজ্যে দ্বিগুণ জরুরি, কারণ পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতিকরা প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করিতে দিবেন, এমন ভরসার আর কোনও কারণ নাই। আদালত বারংবার প্রশাসনকে সুপথে ফিরিতে বাধ্য করিয়াছে বা তাহার চেষ্টা করিয়াছে। কিন্তু এ ধরনের হস্তক্ষেপ আদালতকে যত কম করিতে হয়, ততই মঙ্গল। সুতরাং প্রশাসনের আত্মশুদ্ধিই একমাত্র পথ। সেই শুদ্ধিকরণে সরকারি অফিসারদের নৈতিক অধিকার অবিসংবাদিত, সাম্প্রতিক দৃঢ়তার দৃষ্টান্তগুলিও তাহা জানাইয়া দেয়। পাশাপাশি, তাঁহাদের নৈতিক দায়িত্বও কম নহে। নীতির অবস্থানে দাঁড়াইয়া তাঁহারা বলিতে পারেন না, ‘আমরা ক্ষমতাসীন রাজনীতিকের আজ্ঞাবহ মাত্র’, সেই আজ্ঞা অন্যায় হইলে আইনসম্মত ভাবে প্রতিবাদ করা তাঁহাদের দায়িত্ব। রাজ্যবাসী আশা করিবেন, সেই দায়িত্ব তাঁহারা পালন করিবেন, ব্যতিক্রম হিসাবে নয়, নিয়ম হিসাবে। আপাতত তাহাই বোধ করি পশ্চিমবঙ্গে আইনের শাসন ফিরাইবার একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য উপায়।