কু নমিং থেকে কুয়ালা লামপুর, সিঙ্গাপুর থেকে সাংহাই, কেউ পারেনি, পথিকৃৎ হতে পারে কলকাতা। তামাম দক্ষিণ এশিয়ায় সে হতে পারে আধুনিক স্থাপত্যের বয়ানকে বেঁধে রাখার প্রথম শহর।— এই আধুনিকতা বিশ শতকের মধ্যবিত্ত বাড়িঘরের গঠনশৈলীতে। বেশির ভাগ শহর সেই স্থাপত্যবয়ান নির্বিচারে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। সর্বত্র ঘরবাড়ির রকমফের এখন প্রায় এক: আকাশছোঁয়া অট্টালিকা, ইস্পাত আর কাচে মোড়া একই ধাঁচের সব বহুতল বাড়ি আর শপিং মল।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যেখান থেকে তাঁর চিন সফর শুরু করেছিলেন, সেই শিয়ান শহরের প্রথম এ নিয়ে টনক নড়ে। তত দিনে শাংহাই অট্টালিকার জৌলুসে নিউ ইয়র্ককে ছাপিয়ে গিয়েছে। অথচ আকাশ-ছুঁইছুঁই অট্টালিকাই ছিল না সে শহরের স্থাপত্যের এক এবং একমাত্র বয়ান। উনিশ শতকে আফিং যুদ্ধের পর সাংহাইতে ‘শিকুমেন’ নামে এক ধরনের বাড়ি তৈরি হতে থাকে। চিনে বাড়ির অন্দরমহলে বড় চাতাল থাকত। এই ‘শিকুমেন’ বাড়িগুলি বাইরে থেকে লন্ডনের টাউন হাউসের মতো দোতলা, ভিতরে চিনা বৈশিষ্ট্যের চাতাল। সে সময়ের কসমোপলিটান শাংহাইয়ে স্থাপত্যের নতুন যতিচিহ্ন ছিল এই বাড়িগুলি। খাস শাংহাইয়ে সেই শিকুমেন আজ দুর্লভ।
‘‘শিয়ানে শুরুতেই টনক নড়েছে, সেখানকার পুরনো বাড়িগুলিকে এখন আর নির্বিচারে ভেঙে বহুতল বানানোর অনুমতি দিচ্ছে না চিন,’’ বলছিলেন ইতিহাসবিদ সুগত বসু। কুয়ালা লামপুর নির্বিচারে নিজস্ব স্থাপত্য ধ্বংস করে পেট্রোনাস টাওয়ার তুলেছে, কিন্তু পেনাং শহরে ব্যাপারটা অতটা সহজ হয়নি। নাগরিক আন্দোলনের চাপে সেখানকার একশো বছরের পুরনো বাড়িগুলি এখন শাবল, গাঁইতির হাত থেকে রেহাই পেয়ে যথাযথ সংস্কারের পথে। ‘‘সিঙ্গাপুরও নতুন ভাবে ভাবছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফিস, বাড়িঘর সবই সেই বহুতল। কিন্তু এ বার সিঙ্গাপুরের আইন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতার পর একটা কাফেতে আড্ডা মারতে গেলাম। ক্যাম্পাসের চার দিকে বহুতল, একটা জঙ্গলের মধ্যে পুরনো বাড়িতে কাফে। শহরের স্থাপত্য নিয়ে নতুন করে ভাবছে বলেই সিঙ্গাপুর পুরনো কাফেটা টিকিয়ে রেখেছে, গাঁইতির ঘায়ে ভেঙে ফেলেনি,’’ বলছিলেন সুগতবাবু।
ভাবাভাবিটা শুরু হয়েছে এ শহরেও। সুগত বসু থেকে অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন, কৌশিক বসু, এসথার ডুফলো, চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরী, চিত্রভানু মজুমদার থেকে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া, লেখক অমিত চৌধুরী প্রমুখ ১৩ জনের স্বাক্ষরসংবলিত একটি আবেদনপত্র মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, মুখ্য সচিব সঞ্জয় মিত্রের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আবেদন জানাচ্ছে, ‘কলকাতা এশিয়ার প্রথম কসমোপলিটান মেট্রো নগরী। এখানকার স্থাপত্যবৈশিষ্ট্য মানে শুধু উত্তর কলকাতার রাজবাড়ি বা মধ্য কলকাতার ঔপনিবেশিক আমলের অফিসবাড়ি নয়। বকুলবাগান, হিন্দুস্থান পার্ক, খিদিরপুর, ভবানীপুর বা শরৎ বোস রোড এলাকাও মধ্যবিত্ত ঐতিহ্যের দিক থেকে সমান গুরুত্বপূর্ণ।’ অমর্ত্য সেন যৌথ আবেদনে সই করেন না বলে আবেদনপত্রে তাঁর সই নেই, কিন্তু স্ট্যানফোর্ড থেকে এক চিঠিতে জানিয়েছেন, এই আবেদনে তাঁর সাগ্রহ সম্মতি আছে, ওই সব এলাকা ও বাড়িগুলি বাঁচিয়ে রাখা তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি দায়িত্ব বলেই মনে করেন।
আবেদনের আন্তরিকতা সংশয়াতীত। কিন্তু ভয় হয়, যে শহরে শিল্প মানে ইট, সিমেন্ট আর সিন্ডিকেট, সেখানে বিদ্বজ্জনদের আর্তি টালি নালায় ভেসে যাবে না তো? আবেদনপত্র জানিয়েছে, কিছু এলাকায় ‘হেরিটেজ জোন’ গড়তে হবে, পুরসভার হেরিটেজ কমিটিকে নখদন্তহীন অবস্থায় ফেলে না রেখে কাজের ক্ষমতা দিতে হবে। যে শহরে বাইপাস চওড়া করতে গিয়ে গাছগুলিকে স্থানান্তরিত না করে নির্বিচারে কেটে ফেলা হয়, অর্বাচীন সব ক্লাবের পিছনে লাখ লাখ টাকা দাতব্য করা হয়, সেখানে হেরিটেজ জোন কি দূরাগত ধূসর স্বপ্নমাত্র নয়? প্রশ্ন অনিবার্য।
এবং প্রশ্ন, কলকাতার বা কলকাতা-উদ্ভূত ডাকসাইটে গুণিজনেরাও আসলে কি বর্তমান থেকে চোখ ফিরিয়ে উটপাখির মতোই মুখ গুঁজে থাকতে চাইছেন ঐতিহ্য নামের এক ধূসর মরুভূমিতে? উত্তরে সুগতবাবু এবং অমিত চৌধুরী দু’জনেই: ‘‘না, হেরিটেজ বলতে আমরা মৃত প্রত্নবস্তু সংরক্ষণের কথা বলছি না। মানুষজন যেখানে থাকে, সেই জীবন্ত বাড়িঘর, এলাকাগুলিকে তাদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছি। হেরিটেজ মানে আমাদের কাছে নিছক উনিশ শতক-টতক নয়, জীবন্ত শহর।’’ অমিত আরও একটু এগিয়ে ব্যাখ্যা করে দিলেন, ‘‘ এই মধ্যবিত্ত বাড়িগুলি কিন্তু কলোনিয়াল স্থাপত্যসংস্কৃতি নয়। লাল মেঝে, খোলা ছাদ, লম্বা ছিটকিনি, দেওয়ালে ঘুলঘুলি, জানলা ও দরজায় সবুজ খড়খড়ি... এতগুলি বৈশিষ্ট্য একমাত্র কলকাতার পুরনো মধ্যবিত্ত বাড়িতেই পাওয়া যায়, অন্য কোথাও নয়।’’
ছেলেমেয়েরা সব এই বন্ধ্যা নগরী ছেড়ে দিল্লি, দুবাই, টরন্টো, সিডনিতে সেট্ল করেছে, তারা স্রেফ বাংলা সিনেমা-মার্কা নস্টালজিয়ার টানে বাপ-পিতামহের ভিটে বাঁচিয়ে রাখতে যাবে কোন দুঃখে? যৌথ আবেদনপত্র মুম্বইয়ের ধাঁচে টিডিআর বা ‘ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইট্স’-এর বুদ্ধি দিয়েছে। কলকাতায় পুরনো বাড়ি বিক্রি মানে বকুলতলা বা শরৎ বোস রো়ডের জমিটি বিক্রি করা। বাড়ির যেন দাম নেই! কিন্তু টিডিআর মানে বাড়ির মালিক ওই জমি ডেভেলপ করার স্বত্ব বিক্রি করলেন, তিনি ওই জমিতে আর নতুন নির্মাণ করতে পারবেন না। ডেভেলপারও কিন্তু ওখানে কিছু করতে পারবেন না, তবে সেই স্বত্বাধিকারের বিনিময়ে নতুন কোথাও জমি কিনে সেখানে নির্মাণ করতে পারবেন। বাড়িটি ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যাবে। মুম্বইয়ে অবশ্য সমুদ্র থেকেও জমি নিয়ে বান্দ্রা-ওরলি সি লিঙ্ক তৈরি করা যায়। কিন্তু যে শহরে নতুন রাস্তা, মেট্রো স্টেশন থেকে শিল্পের জন্যও প্রয়োজনীয় জমি পাওয়া যায় না, সেখানে এই বুদ্ধি আদৌ সম্ভব? ভবানীপুরে বাড়ি কিনে কোন ডেভেলপার বারুইপুরে সমতুল জমির ওপর বাড়ি বানাবেন?
বিদ্বজ্জনেরা অবশ্য আশা ছাড়ছেন না। চিঠি মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে জমা পড়ার সপ্তাহ খানেক পরে, মে মাসের শেষ দিকে অমিত চৌধুরী জানালেন, ‘‘খবর নিয়েছি। কর্পোরেশন বলল, আবেদনটা নিয়ে টপ লেভেলে নাড়াচাড়া হচ্ছে।’’
মনে পড়ল, এই শহরের আদিগঙ্গা অঞ্চলে আরও একটি জীবন্ত ঐতিহ্য আছে। সেটি ‘কাঙাল মালসাট’-এর। নবারুণ ভট্টাচার্যের সেই উপন্যাসের এক চরিত্র বলেছিল, ‘সবাই টপ সয়েলে আঁচড়াচ্ছে। কোনও লাভ হবে না।’