প্রবন্ধ ১

যে গণতন্ত্র আমাদের চেষ্টায় আসবে

প্রকৃত গণতন্ত্র হল অনাগত গণতন্ত্র। যে গণতন্ত্র সম্পূর্ণ হয়নি, হয়তো কখনও সম্পূর্ণ হয় না। গণতন্ত্রের এই স্বপ্নকে স্বাধীনতা স্তিমিত করেনি, উল্টে তীব্রতর করেছে। রণবীর সমাদ্দারদেশ, জাতি নিয়ে ভাবনা সব সময়ে এক নির্দিষ্ট কালের দ্যোতনা বহন করেছে। সেই দ্যোতনার মধ্যে তদানীন্তন কালের ছাপ থেকে গেছে। কিন্তু দেশ এবং জাতি এমনই এক ভাবনার উদ্রেক করে, যার মধ্যে কালাতীত কালেরও স্বাক্ষর পাওয়া যায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০
Share:

প্রান্তিক। আদিবাসী জমি রক্ষা কমিটি। ইসলামপুর, উত্তর দিনাজপুর, জুলাই ২০১৩।

দেশ, জাতি নিয়ে ভাবনা সব সময়ে এক নির্দিষ্ট কালের দ্যোতনা বহন করেছে। সেই দ্যোতনার মধ্যে তদানীন্তন কালের ছাপ থেকে গেছে। কিন্তু দেশ এবং জাতি এমনই এক ভাবনার উদ্রেক করে, যার মধ্যে কালাতীত কালেরও স্বাক্ষর পাওয়া যায়। মনে হয়, কালের সকল বাধা অতিক্রম করে স্বদেশ স্বদেশ রয়েছে, এ জাতি আমাদের ছিল, আমাদেরই আছে। আমাদের দেশ ও জাতিকে আমাদের থেকে কেড়ে নেয়, কার সাধ্য?

Advertisement

অনাদিকাল থেকে যা আমাদের, তাকে ছিনিয়ে নেবে কে?

এ দিকে দেশশাসকদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটেছে, ঘটবে। জাতির পরিচয়কে এক নির্দিষ্ট চিত্রকল্পে বেঁধে দেশবাসীর বৈচিত্রসম্পন্ন কল্পনাকে বাঁধার চেষ্টা চলবে। সে চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হতে থাকবে, সত্তাবোধের বিস্ফোরণ হবে। যেমন স্বাধীনতার পরবর্তী সাতষট্টি বছর ধরে বিস্ফোরণ ঘটেছে। প্রতিটি বিস্ফোরণেই পাওয়া গেছে দেশ এবং জাতির সংজ্ঞার পুনর্নিরূপণের প্রয়াসের ইঙ্গিত। কিন্তু দেশ জাতি কাল আমাদের চিরসঙ্গী থেকে গেছে।

Advertisement

যারা দেশ এবং জাতি থেকে বহির্ভূত, তারা বলেছে এবং বলবে যে, এই দেশ এবং জাতি আমাদের বাদ দিয়ে হয় কী করে? এই দেশ এবং জাতি কল্পনায় আমাদেরও অধিকার আছে। সমাধিকার। অথবা সর্বাগ্রাধিকার। এই ভাবে স্বাধীন সত্তা এবং সাম্যবোধ দেশ এবং জাতির পরিচয়কে বাঁচিয়ে রেখেছে এবং রাখবে। তাই ১৯৪৬-৪৭-এ এ দেশের কমিউনিস্টরা ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ বলে হয়তো ভুল করেছিলেন, এক গূঢ় অর্থে তাঁরা ভুল করেননি। তার কারণ, দেশ ও জাতির পবিত্রকল্পকে তাঁরা দেশ ও জাতির তদানীন্তন খণ্ডিত রূপের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেননি। একাকার করে দেননি, দেশ, জাতি এবং যে রূপে স্বাধীনতা এল এই তিনটিকে।

রাজনৈতিক কল্পনার এই প্রবল শক্তি দেশ এবং জাতির জীবনে বার বার দেখা গেছে। এর রহস্য এই বিত্তসর্বস্ব, প্রশাসনিকতাকেন্দ্রিক জীবন ও বিশ্লেষণপদ্ধতি দিয়ে বোঝা দুষ্কর। প্রতিনিয়ত নানা দিক দিয়ে এই মায়াবি শক্তি বোঝে দেশজাতিবহির্ভূত মানুষ, যার কল্পনায় ন্যায় এবং বিচারবোধে চিহ্নিত দেশকাল অভূতপূর্ব শক্তিতে বিদ্যমান।

বহির্ভূতরা বলতেই পারে, এই দেশ এবং জাতি আমাদের চাই না, আমরা বাইরে থেকেছি, বাইরেই থাকব। সে আকাঙ্ক্ষা এবং মনোভাবের দৃঢ়তাকে সম্মান না জানিয়ে উপায় নেই। কুর্নিশ করে বলতেই হবে তোমার নিজের দেশ জাতি গঠনে সাফল্যের জন্য শুভেচ্ছা রইল। কিন্তু বহির্ভূতদের সুবিপুলাংশ যারা বলল, এই দেশ এবং জাতি আমাদেরও, অথবা প্রথমে আমাদেরই, দেশজাতির জীবনালেখ্যে তাদের কল্পশক্তির প্রভাব এবং স্বাক্ষর গভীর। এই শক্তি দেশ এবং জাতির এ-কাল এবং কালাতীত কালের যুগ্মপরিচয়ের ইঙ্গিত বহন করে।

আমরা এমন এক কালের মধ্যে দিয়ে চলেছি, যে সময়ে দেশজাতিভাবনা দুর্বল হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। অভিবাসন, বহির্গমন, দেশত্যাগী বাস্তুহারা লক্ষকোটি মানুষের ভিড়, স্থানান্তরী এবং দেশান্তরী শ্রমিক, নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির বাঁধনহারা বিশ্বায়ন, আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির দৌলতে বাধাহীন, সীমানাহীন মেলামেশা এবং চিন্তাবিনিময়ের কল্পজগত্‌ এই সবের প্রাবল্যে এবং আঘাতে দেশজাতির মৃন্ময় রূপ ভেঙে যাওয়ার কথা। ভেঙেছেও কিছু ক্ষেত্রে। কিন্তু তার চিন্ময় রূপ শুধু অক্ষত থাকেনি, আঘাত সেই কালাতীত রূপকে পুনঃশক্তি দিয়েছে।

অন্য দেশকল্পনা

এর অর্থ এই যে, নাগরিকত্ব এবং সাংবিধানিক স্বীকৃতির সঙ্গে দেশ এবং জাতি নির্মাণে অংশগ্রহণের অধিকার ঘোষণাকেও মেলানো যাবে না। কল্পশক্তি দিয়ে যে অংশগ্রহণ, তার কতটুকু সাংবিধানিক অংশগ্রহণ দিয়ে বোঝা যায় বা মাপা যায়?

পরাধীন যুগে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের লাহৌর বা করাচি সম্মেলনে এই কল্পনার যে প্রাবল্য দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছিল, অথবা সেই একই প্রাবল্যের এক উদগ্র ও সর্বনাশা রূপ দেখেছিল ১৯৪৬-এর কলকাতা, সেই মনমোহিনী অথবা সংহারক মূর্তির তেজ এখনও হ্রাস পেয়েছে মনে হয় না। দলিতজনসাধারণ, গরিবসমাজ, জনজাতি এবং শ্রমজীবী শ্রেণিসমূহের অন্যতম বড় অবদান এই যে, তাঁরা দেশজাতির ভাবনাকে বিত্তবান, বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক এবং নেতৃবর্গের আওতা থেকে বার করে আনতে পেরেছেন। দেশজাতিকাল ভাবনা দর্শনের বিষয় নয়, এই ভাবনা আজ জনচৈতন্য বা সাধারণ চৈতন্যের অংশ হয়ে গেছে।

এক দিকে রাষ্ট্রক্ষমতা যত কেন্দ্রীভূত হয়েছে, যত হিংসা এবং বলপ্রয়োগ বেড়েছে, তত দেশবাসী ভেবেছে, স্বাধীনতা যে গণতন্ত্র এনেছে, তা প্রকৃত গণতন্ত্র নয়। আমাদের প্রকৃত গণতন্ত্র চাই। প্রকৃত গণতন্ত্র হল অনাগত গণতন্ত্র। যে গণতন্ত্র আসবে, যে গণতন্ত্র সম্পূর্ণ হয়নি, হয়তো কখনও সম্পূর্ণ হয় না, যে গণতন্ত্র আমাদের চেষ্টায় আসবে। রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা চাই। অঞ্চলের বিকাশ চাই। নারীর মর্যাদা চাই। শিশুকল্যাণ শিক্ষা স্বাস্থ্যের উন্নতি চাই। মজুরিবৃদ্ধি চাই। শ্রমিকের জীবিকার নিরাপত্তা চাই। কৃষকের জীবনমানের উন্নতি চাই। এ সবই সেই অনাগত গণতন্ত্রের প্রতীক। গণতন্ত্রের এই স্বপ্নকে স্বাধীনতা স্তিমিত করেনি, উল্টে তীব্রতর করেছে।

কিন্তু মজার কথা হল, অনাগত গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখা সম্ভব একমাত্র আজকের গণতন্ত্রে স্বীয় দাবি এবং স্থান ঘোষণা করে। তাই স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র পরস্পরের সঙ্গে এত জড়িয়ে গেছে। আমরা গণতন্ত্রের দাবি করি, কারণ ওটা আমাদের স্বাধিকার। আমাদের অধিকার আছে সমান হওয়ার। সম্মান এবং স্বীকৃতি পাওয়ার। দেশ, জাতি এবং অধিকারবোধ এই ভাবে আমাদের জনজীবনে এবং জনচৈতন্যে স্বাধীনতা এবং সমানবোধকে যুক্ত করেছে। যা তত্ত্বে সম্ভব নয়, যার মূর্তরূপ দেখা অসম্ভব, জনরাজনীতি তাকে সম্ভব করেছে। দেশ জাতি এ কালের রাজনৈতিক কল্পনার সুদূর সীমা নির্ধারণ করেছে। সেই সীমানায় দাঁড়িয়ে আমাদের রাজনৈতিক কল্পনাকে ক্রমাগত প্রসারিত করার হাতছানি দেয় দেশজাতিভাবনা। স্বাধীনতার কল্পমূর্তির ক্রমে দূরে সরে গিয়ে ক্রমাগত কাছে চলে আসার এ-রকম উদাহরণ অন্যান্য দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে আছে কি না জানি না। কিন্তু এ দেশে তা ঘটছে।

প্রশ্ন জাগে, কোন সেই শূন্যতা সাতষট্টি বছর আগে সৃষ্টি হয়েছিল, যে শূন্যতা ভরাট করতে আমাদের রাজনৈতিক কল্পনা ক্রমশ নানা চিত্রের সৃষ্টি করে চলেছে? সাতষট্টি বছর আগে স্বাধীনতা ঘোষণায় শূন্যতা ভরে যাওয়ার কথা ছিল। দেশ স্বাধীনতা পেল, জাতি মুক্তি পেল, জনগণ বিপ্লব কামনা করল এই ছিল ১৯৪৭-এ রাজনৈতিক কল্পনার অন্য ত্রিবর্ণ। কিন্তু শূন্যতা ভরাট হল না। দেশজাতিকালের সংজ্ঞার নতুন নিরূপণের দিকে আমরা এগিয়েছি। এই সত্তর বছরের মতো সময়ে যত নতুন প্রতিষ্ঠানই তৈরি হোক না কেন, জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষা তাতে চরিতার্থ হয়নি।

ইহজাগতিক রাজনৈতিক সমাজে আমরা সমানাধিকার না পাই, কিন্তু অন্য জগতের কথা কল্পনা করার সমানাধিকার তো কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। সেই অনাগত জগতে সবাই সমান, সবাই নাগরিক। নব্য উদারনীতি, নব্য অর্থনীতি, বিত্তের কেন্দ্রীভূত হওয়ার প্রবল বেগ, দারিদ্র এবং সামগ্রিক ভাবে জীবনজীবিকার অনিশ্চিতি যত বেড়েছে, ততই রাজনৈতিক কল্পনার তাগিদ বৃদ্ধি পেয়েছে।

সদ্য প্রয়াত কবি নবারুণ ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না। নিজের দেশ, যা এক মৃত্যু উপত্যকা, তাকে অস্বীকার করার মধ্যে নিজের দেশের এক গভীর স্বীকৃতি আছে। সেই অন্য দেশকল্পনার দ্যুতি স্বাধীনতা দিবসের বিবর্ণতার বিপরীতে এক এক সময় আমাদের চোখ ঝলসে দেয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর অধিকর্তা। মতামত ব্যক্তিগত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন