স্বাধীনতার দাবি। গণভোটের প্রচারপর্ব। গ্লাসগো, স্কটল্যান্ড। গেটি ইমেজেস
গত ১৮ সেপ্টেম্বর স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে স্কটল্যান্ডে গণভোট হয়। স্বাধীনতা মানে তিনশো বছরেরও বেশি ইংরেজ শাসনের অবসান। গ্রেট ব্রিটেন এবং যুক্তরাজ্য থেকে মুক্তি। ৩৬ লক্ষ ভোটারদের ৮৪ শতাংশ ভোট দেন। স্বাধীনতা প্রস্তাবের পক্ষে পড়ে ৪৫ শতাংশ ভোট, বিপক্ষে ৫৫ শতাংশ। স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টা ব্যর্থ হলেও এই ভোট থেকে অনেক কিছুর শেখার আছে।
মুদ্রা, বাজেট ঘাটতি, সম্মিলিত ইউরোপের সদস্যপদ, উত্তর সাগরের (নর্থ সি) তেল এবং সরকারি ব্যয়, এই সব প্রশ্নে জনসাধারণের এক বড় অংশকে স্বাধীনতা-বিরোধীরা নিজেদের দিকে টেনে নেয়। স্বাধীন স্কটল্যান্ড নৈরাজ্যের, অর্থ ঘাটতির এবং রাজস্ব ঘাটতির লীলাভূমি হয়ে দাঁড়াবে, এই আশঙ্কা ও ভীতি গণভোটকে পরাস্ত করে। একই ভাবে কৃষি, সীমানা নিয়ন্ত্রণ, অভিবাসন, নাগরিকত্ব, জনকল্যাণ, প্রতিরক্ষা, পরমাণু অস্ত্র মোতায়েন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও নেটো-র সদস্যপদ, মুদ্রা, তেল, শিক্ষা, গবেষণা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে এক বছর ধরে প্রচার, আলাপ-আলোচনা, ভীতি প্রদর্শন, প্রলোভন, হিংসা, সবই চলে। স্বাধীনতাকামীদের বক্তব্য ছিল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বাধীন স্কটল্যান্ড সমস্যা সামলাতে পারবে। যেগুলো অধিক প্রতিকূল হয়ে দাঁড়াবে, সেই সব ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড এবং ইইউ সাহায্য করুক। যেমন, নতুন দেশ হিসেবে স্কটল্যান্ডের ইইউ’তে যোগ দিতে, বিশেষত ইউরোকে নিজস্ব মুদ্রা করে নিতে কিছু বছর লাগবে, তত দিন পাউন্ড-স্টার্লিং চলুক। কিন্তু ব্রিটিশ ব্যাংক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদরা সম্মত হননি।
ভোটের ফল দেখে স্বাধীনতা-বিরোধী মহলে স্বস্তি ও উল্লাসের ঝড় বয়ে যায়। বারাক ওবামা ও ডেভিড ক্যামেরন বলেন, ইউরোপ বাঁচল, ব্রিটেনও। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান নেতা অ্যালেক্স সালমন্ড পরাজয়ের দায় স্বীকার করে স্কটিশ ফার্স্ট মিনিস্টার পদ ত্যাগ করেন। বলেন, ‘আমার সময় শেষ, কিন্তু স্কটল্যান্ডের স্বপ্নের মৃত্যু হবে না।’
কানাডা, স্পেন, নরওয়ে এবং অন্য কিছু দেশের নেতারা উল্লসিত হয়েছেন স্বাধীনতা প্রস্তাবের পরাজয়ে। এ সব দেশে আত্মনিয়ন্ত্রণের স্বতন্ত্র দাবি ও সংগ্রাম আছে। যেমন, বাস্ক, ক্যাটালনিয়ার নেতৃবৃন্দ আশা প্রকাশ করেছেন, তাঁদের কেন্দ্রীয় সরকারও গণভোট আয়োজনে সম্মত হবেন। তাঁদের প্রশ্ন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গণভোট থেকে পিছিয়ে যায় কেন? ইউরোপে একমাত্র রাশিয়া অন্য মত প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, স্কটল্যান্ডের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে তাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা স্বাভাবিক।
ইতিহাস
ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে ১৭০৭ পর্যন্ত স্কটল্যান্ড ছিল স্বাধীন, যদিও সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ায় দু’দেশের রাজপরিবারের মিলন ঘটে, ১৬৫৩-য় অলিভার ক্রমওয়েলের আমলে দুই সরকারের মিলন হয়। ইংরেজ আগ্রাসন সফল হয় ১৭০৭-এ। এই মিলনের নাম হয় গ্রেট ব্রিটেন। ইংরেজ রাজপরিবার দুই দেশের রাজপরিবার হিসেবে স্বীকৃত হয়। ১৮০১ সালে গ্রেট ব্রিটেন গিলে ফেলে আয়ারল্যান্ডকে। সম্মিলিত ভূখণ্ডের নাম হয় ইউনাইটেড কিংডম বা যুক্তরাজ্য।
লেবার পার্টি ১৯২০ পর্যন্ত স্কটল্যান্ডে আত্মশাসনের পক্ষে ছিল। কিন্তু এ দল ক্রমশ কনজার্ভেটিভদেরই এক রূপে পরিণত হয়েছে, স্কটল্যান্ডের আত্মশাসনের দাবি থেকে সরে এসেছে। অন্য দিকে, স্কটিশ জাতীয়তাবাদী দল ১৯৬০ থেকে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে এসেছে। চল্লিশের দশকের শেষে ২০ লক্ষ লোক স্বাধিকারের পক্ষে সনদে সই করেন। তখন স্কটল্যান্ডের জনসংখ্যা ৫০ লক্ষ। দীর্ঘ প্রচার ও রাজনৈতিক সংগ্রামের ফলে ১৯৮৮’তে স্কটল্যান্ড আইন পাশ হয়, প্রতিষ্ঠিত হয় স্কটিশ পার্লামেন্ট। ৬ মে ১৯৯৯-এ স্কটিশ সংসদ কাজ শুরু করে স্কটল্যান্ডের অভ্যন্তরে অসংরক্ষিত বিষয়গুলিতে আইন পাশের অধিকার সম্বল করে। ২০০৭-এর নির্বাচনে স্কটল্যান্ডে ক্ষমতায় এসে জাতীয়তাবাদী দল ঘোষণা করে, পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে ২০১০-এর মধ্যে গণভোট সংগঠিত করবে। ২০১৪-র এই গণভোট সেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পরিণাম।
ভবিষ্যতের স্বাধীন স্কটল্যান্ডের সম্ভাব্য সমস্যাবলি ও তার সমাধানের পথ নিয়ে স্কটিশ সংসদে বারংবার আলোচনা হয়েছে। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের প্রকৃত পথ কী? অর্থনৈতিক সংস্কার হবে কোন পথে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল ব্রিটিশ কূটনীতি থেকে সরে এলে স্কটল্যান্ড প্রতিরক্ষা এবং বিদেশ নীতির কোন পথ নেবে? শেষের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় গুরুত্বপূর্ণ, কারণ স্কটিশ জাতীয়তাবাদীরা দাবি করেছিল, স্কটল্যান্ড থেকে মার্কিন পারমাণবিক ও প্রতিরক্ষা ঘাঁটি সরুক।
বিশ্বব্যাপী যে-সব রাজনৈতিক শক্তি স্বাধীনতা এবং স্বশাসনের জন্য সংগ্রাম করছে, তাদের অবশ্যপাঠ্য হল ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩-য় প্রকাশিত স্কটিশ জাতীয়তাবাদী সরকারের আলোচনাপত্র: স্কটল্যান্ড’স ফিউচার। ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের অর্থনৈতিক যোগাযোগ যতটা গভীর হয়ে পড়েছে, তাতে জাতীয়তাবাদী প্রস্তাব সহজেই পরাস্ত হওয়ার কথা ছিল। ব্যাংক অব স্কটল্যান্ডের সংকট তার অন্যতম প্রতিফলন। এক অর্থে, বৃহত্ পুঁজি নিয়ন্ত্রিত স্কটিশ অর্থনীতি স্বাধীনতার রাজনীতিকে পরাস্ত করল, অন্তত এ বারের মতো। বহু অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, উচ্চ প্রযুক্তিভিক্তিক পেশা, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বিভাগসমূহ, যেগুলোকে বলা চলে নয়া উদারনীতিবাদের কর্মক্ষেত্র, সেই সব প্রতিষ্ঠান ও পেশাসমূহ স্বাধীনতার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। অন্য দিকে, অন্য সমস্ত পেশা, শ্রমিককুল, সংগঠিত সামাজিক গোষ্ঠীসমূহ দাঁড়ায় স্বাধীনতার পক্ষে। জয়ী হয় নয়া উদারনীতিবাদ, বিশ্বায়ন এবং তত্প্রসূত রাজনীতি।
তবু, এ সবের মধ্য দিয়ে আলাপ-আলোচনার পথ কেটে স্বাধীনতার স্পৃহা ও বাণী যে এত দূর পৌঁছেছে, তা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। স্কটল্যান্ডের সমাজতন্ত্রী এবং গণতন্ত্রীরা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীতে পর্যবসিত হয়নি। যারা স্কটল্যান্ডে থাকে, সবার কাছেই তারা তাদের আবেদন পৌঁছে দিতে চেয়েছে। গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতার মূল্য দিয়েছে। বড় পুঁজির কাছে তাদের পরাজয় হল, কিন্তু তাদের সহিষ্ণুতা এবং উদারতার ন্যায্য সম্মান ইতিহাসে দেবে।
এর একটা বড় মাপকাঠি হল, কারা এই ভোট দিল?
উদারতা
সমস্ত ব্রিটিশ নাগরিক, যারা স্কটল্যান্ডে বসবাস করে; ৫২টা অন্য কমনওয়েলথ দেশবাসী, যারা স্কটল্যান্ডে বসবাস করে; ২৭টা অন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশের নাগরিক, যারা স্কটল্যান্ডে থাকে; ব্রিটিশ সংসদের উচ্চসভার যে-সব সদস্য স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা; এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যবৃন্দ, যারা স্কটল্যান্ডের ভোটাধিকারী। স্কটিশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গণভোটের সময় ভোটাধিকার প্রসঙ্গে এক অভূতপূর্ব উদারতা দেখিয়েছে।
সবচেয়ে নজর কাড়ে অভিবাসী শ্রমিক কর্মচারী গবেষক ইত্যাদি জনমণ্ডলীর ভোটাধিকার। আমরা এখনও জানি না, অভিবাসী শ্রমিক কর্মচারীরা কোন দিকে ভোট দিয়েছে। কিন্তু চিন্তা করুন, আমাদের দেশে পঞ্জাবের বিভিন্ন শহর ও গ্রামাঞ্চলে অভিবাসী বিহারি শ্রমিকদের কি আঞ্চলিক নির্বাচনে ভোটাধিকার দেওয়া হয়?
এক দিকে এই উদারতা এসেছে গত কুড়ি-পঁচিশ বছরে, গভীরতর অর্থনৈতিক বন্ধনের প্রক্রিয়ার থেকে। কিন্তু অন্য দিকে, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা গণতন্ত্রের গভীরতায় প্রোথিত। হয়তো, তার শ্রমজীবী অন্তর্বস্তু স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে গণতান্ত্রিক করেছে।
এই গণতন্ত্রের মুখোমুখি হল একচেটিয়া পুঁজি। রয়্যাল ব্যাংক অব স্কটল্যান্ড, লয়েডস, ক্লাইডসডেল ব্যাংক, টেসকো ব্যাংক এরা সবাই হুমকি দিয়েছিল যে, স্কটল্যান্ড স্বাধীন হলে এরা সবাই তাদের সদর দফতর ইংল্যান্ডে সরিয়ে নেবে, কর্মচারীরা স্থানান্তরিত হবেন, তাঁদের চাকরি যাবে। স্কটল্যান্ডের বৃহত্তম আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড লাইফও ওই কথা বলেছিল। অন্য দিকে, স্কটল্যান্ড উত্তর সাগরের তেলের আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত থেকেছে বহু বছর। মোট উত্পাদনের এক বড় অংশের উত্স হলেও, স্কটল্যান্ডের কাছে ফেরত আসত তার থেকে অনেক কম। এই জন্যই মুদ্রার প্রশ্ন স্কটিশ স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এক বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। অনুরূপ বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়, স্কটল্যান্ডের প্রয়োজন, দাবি এবং অবদানের নিরিখে ব্রিটিশ সরকার কি স্কটিশ জনসাধারণের জন্য সামাজিক খাতে উপযুক্ত ব্যয় করে?
দূর দেশের স্বাধীনতা অর্জনের এই ব্যর্থ কাহিনি থেকে দু-তিনটে কথা আসে। তাত্পর্যপূর্ণ বিষয় যে, স্বাধীনতার পথে নিবেদিত থাকতে গিয়ে স্কটিশ সমাজতন্ত্রী এবং জাতীয়তাবাদীরা আলাপ-আলোচনার পথ ত্যাগ করেননি। বহু জটিল বিষয়ে তাঁরা মনোনিবেশ করেছেন। চিন্তা করেছেন, পাল্টা পরিকল্পনা পেশ করেছেন। ধৈর্য হারাননি। এ বার গণভোটে তাঁরা পরাস্ত হলেন বটে, কিন্তু ইউরোপের স্বাধীনতাকামী শক্তি, যেমন বাস্ক বা উত্তর আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতাকামীরা তাঁদের এই গণতান্ত্রিক অভিযান থেকে সম্মান পেয়েছেন।
আমাদের দেশের বামপন্থীরা আলাপ, সংলাপের পথের তাত্পর্য আজও অনুধাবন করেন না। প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সংঘাত এবং নির্মাণ যে সংলাপের পথেও হতে পারে, তাঁরা বিশ্বাস করেন না। স্কটল্যান্ডের দৃষ্টান্ত এর বিপরীত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ইঙ্গিত দেয়। এই অভিজ্ঞতা আমাদের দেশের অন্যান্য স্বাধিকারকামী আন্দোলনের কাছেও সমান তাত্পর্যপূর্ণ হওয়া উচিত।
জাতীয়তাবাদ এবং গণতন্ত্র কি একই পথ এবং অভিজ্ঞতার শরিক হতে পারে? এ ক্ষেত্রেও স্কটল্যান্ড ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা, বিশ্বায়ন এবং নয়া উদারনীতিকরণের যুগে স্বাধিকারের আকাঙ্ক্ষা এবং বৃহত্ পুঁজি নির্দেশিত আর্থিক সংযোগ ও সংযুক্তি কী ভাবে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে চলেছে, স্কটিশ স্বাধীনতা প্রয়াস তার এক বড় নিদর্শন। শ্রমজীবী ঐক্য এবং স্বাধিকার ঘোষণার এক মিলনক্ষেত্র আছে, যা ঈশ্বরপ্রদত্ত নয়, যাকে খুঁজে বার করে নিতে হয়। এর এক বড় কাহিনি এই পরাজয়গাথার মধ্যে রয়েছে।
স্কটল্যান্ড এক সুদূর দেশ। কিন্তু তার স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষার কাহিনি মনে হয় এ দেশেরই অতি পরিচিত কিছু কাহিনির সঙ্গে সাদৃশ্য বহন করে চলেছে!
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপের অধিকর্তা। মতামত ব্যক্তিগত