প্রবন্ধ ১

যে মন ভোলে না

দু’দশকের নবীন গণতন্ত্র দক্ষিণ আফ্রিকা। অনেক সমস্যা। অনেক ত্রুটি। কিন্তু ওঁরা সাধারণ মানুষের অতীতকে সম্মান করতে জানেন। দেখে ভরসা হয়।কাঠের সিঁড়ির ধাপে ধাপে লেখা আছে রাস্তার নাম: রিচমন্ড স্ট্রিট, প্রিমরোজ স্ট্রিট, ভার্জিনিয়া স্ট্রিট... এক একটা ধাপে পা দিলেই যেন পৌঁছে যাচ্ছি সেই সেই রাস্তায়। রাস্তাগুলি এখন অবশ্য আর নেই। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলে সারি-সারি খোপ-খোপ ঘর।

Advertisement

বোলান গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০২
Share:

কাঠের সিঁড়ির ধাপে ধাপে লেখা আছে রাস্তার নাম: রিচমন্ড স্ট্রিট, প্রিমরোজ স্ট্রিট, ভার্জিনিয়া স্ট্রিট... এক একটা ধাপে পা দিলেই যেন পৌঁছে যাচ্ছি সেই সেই রাস্তায়। রাস্তাগুলি এখন অবশ্য আর নেই। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলে সারি-সারি খোপ-খোপ ঘর। চুল কাটার সেলুন, মনিহারি দোকান, এক টুকরো শোবার ঘর, পাশেই ফোন-বুথ। ঠিক যেন ফিরে যাওয়া পুরনো পাড়ায়। মাঝে মাঝে লেখা স্থান-কাল-পাত্রের বিবরণ। দোতলায় রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালে দেখা যায় একতলার বিশাল হলঘরের মেঝেতে আঁকা ‘ডিস্ট্রিক্ট সিক্স’-এর ম্যাপ।

Advertisement

দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন শহরের ডিস্ট্রিক্ট সিক্স মিউজিয়মে এসে দাঁড়ালে ইতিহাস কথা বলে। প্রাসাদ, মন্দির, চার্চ, আত্মজীবনী অথবা ধ্বংসাবশেষ, নানান সব চিহ্ন দিয়ে তৈরি হয় মিউজিয়ম। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন বেঁচে থাকার কোনও চিহ্ন থাকে না, ধ্বংসাবশেষও না। অথচ সেই মানুষের কাঁধে ভর দিয়েই ইতিহাসের যাত্রা। এই প্রথম একটি মিউজিয়মে এসে দাঁড়ালাম, যেখানে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন যাপনকে হয়ে উঠেছে ইতিহাসের সাক্ষ্য। মহৎ হিসেবে দেগে দেওয়ার কোনও চেষ্টা নেই। সবটাই চেনা মানুষের চেনা দিন গুজরান। অথচ তার মধ্যেই লুকিয়ে ভয়ংকর এক সময়ের দলিল। রাষ্ট্রীয় হিংস্রতার রক্তচক্ষুও।

১৯৪৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার বর্ণবৈষম্য নীতিকে আইনি সিলমোহর দেয়। চার ভাগে ভাগ করে দেশের মানুষকে: সাদা, কালো, রঙিন এবং ভারতীয়। ভিতরে ভিতরে আসল ভাগটা অবশ্য সাদা আর অ-সাদা। দেশের মাটিও ভাগ হয়। সাদাদের জন্য নির্দিষ্ট হয় কিছু কিছু জায়গা আর কালোদের জন্য কিছু জায়গা। সমুদ্রসৈকত থেকে শুরু করে পার্কের বেঞ্চ, এমনকী ফোন-বুথেও লেখা থাকত কোনটি সাদারা ব্যবহার করবে, কোনটি অ-সাদারা। কালোদের জন্য নির্দিষ্ট ‘বান্টুস্তান’-এর বাইরে এসে সাদাদের এলাকায় ঢুকতে গেলে পরিচয়পত্র দেখাতে হত। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, সব বিষয়েই বৈষম্য চালু হয় সরকারি ভাবে।

Advertisement

১৯৬৬’র ১১ ফেব্রুয়ারি কেপ টাউন-এর ছয় নম্বর পুর এলাকা, ডিস্ট্রিক্ট সিক্স-কে সরকারি ভাবে সাদাদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। শহরের মাঝখানে দেড় স্কোয়ার কিলোমিটার প্রসারিত অঞ্চলটিতে গোড়ার দিকে থাকত মুক্তি পাওয়া দাস, অভিবাসী, শ্রমিক, বণিক আর কারিগরেরা। পরে আসেন শিল্পী, ব্যবসায়ী, গায়ক, লেখক, শিক্ষক, পুরোহিত, গ্যাংস্টার, খেলোয়াড়। সব রকমের মানুষ নিয়ে ডিস্ট্রিক্ট সিক্স হয়ে ওঠে জমজমাট। তবে বেশির ভাগই ছিল অ-সাদা। সব মিলিয়ে ষাট থেকে সত্তর হাজার মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষ মিলেমিশে একে অপরের সুখ-দুঃখের ভাগিদার হয়ে বাস করতেন। সিনেমা হল, কাফে, যৌথ স্নানাগার, বাজার— যা যা দরকার হয়, সবই ছিল হাতের গোড়ায়। ’৬৬ সালের নোটিসের পর, ১৯৭৫ সালের মধ্যে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় পুরনো ঘরবাড়ি। সাদাদের জন্য তৈরি হয় নতুন এক অঞ্চল। উচ্ছেদ হওয়া মানুষ এখানে-ওখানে হারিয়ে যায়। প্রসঙ্গত, ১৯৬০ থেকে ’৮৩ পর্যন্ত গোটা দক্ষিণ আফ্রিকায় পঁয়ত্রিশ লক্ষ মানুষকে এই ভাবে উচ্ছিন্ন হতে হয়েছে। ডিস্ট্রিক্ট সিক্স মিউজিয়াম-এ সেই উচ্ছেদের ইতিহাস ধরা আছে শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন যাপনের ছবির মধ্যে। বস্তুত গোটা দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়েই চোখে পড়ে সাধারণ মানুষের কথাকে হাইলাইট করার একটা চেষ্টা।

দাস-ব্যবসার এক সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে কেপ টাউনের। ওলন্দাজ বণিকরা দাস নিয়ে আসত জাহাজ ভর্তি করে। দক্ষিণ আফ্রিকার মূল কেন্দ্রটি ছিল কেপ টাউন। তখন এখানে ব্যবসাবাণিজ্যের রমরমা। দাস কেনাবেচাও তার একটা অংশ। ১৬৭৯ সালে ওলন্দাজরা একটি বাড়িই তৈরি করে, যেখানে ‘ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ জাহাজ ভর্তি করে আনা দাসদের জমা করত। এক হাজার দাস সেখানে কোনও রকমে থাকতে পারত। তার ২০ শতাংশ পথকষ্টে বা নানা কারণে মারা যেত। এই দাসরা আসত মিশর, গ্রিস, রোম, ভারত ও অন্যান্য পূর্বদেশ থেকে। সেই বাড়িতে এখন তৈরি হয়েছে ‘স্লেভ লজ’ মিউজিয়ম। এই দাসদের কী ভাবে আনা হত, কেমন ভাবে রাখা হত, সবই সেখানে প্রদর্শিত। ধরা আছে কঠিন এক অপমান আর অত্যাচারের ইতিহাস!

এই একই ভাবনায় তৈরি হয়েছে জোহানেসবার্গের ‘অ্যাপারথাইট মিউজিয়াম’। (সঙ্গের ছবিতে তার একটি অংশ) ১৯৪৮ সাল থেকে ’৯৪ সাল পর্যন্ত বর্ণবৈষম্যের উপর ভিত্তি করে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল, সেই ব্যবস্থা আর তার থেকে মুক্তি পাওয়ার সংগ্রামের ইতিহাস ধরা আছে। নেতাদের পাশাপাশি অখ্যাত অনামা মানুষ, তাদের সংগ্রাম, আর অত্যাচারিত হওয়ার কাহিনি কম গুরুত্ব পায়নি। তারাই যে গণ-জাগরণের চালিকাশক্তি, এ কথা ভুলে যাওয়া হয়নি। ‘মেমারি বক্স’ শিরোনামে আলাদা করে ধরা আছে বহু মানুষের স্মৃতি। তাঁদের বাঁচা, সংগ্রাম, ভাল লাগা, মন্দ লাগা নিয়ে মানবিক পরিচয়।

জোহানেসবার্গের ‘কনস্টিটিউশন হিল’ও সেই একই চিন্তার শরিক। একটা পুরনো দুর্গকে প্রথমে সাদাদের, পরে তাতে দেশীয় অপরাধীদের জন্য জেলখানা বানানো হয়েছিল। সাদাদের অংশটিকে ‘নাম্বার ফোর’ বলা হত, আর পরবর্তী কালে যুক্ত হওয়া দেশীয় লোকদের অংশটিকে ‘সেকশন ফোর’ আর ‘সেকশন ফাইভ’ বলা হত। এই অংশে গাঁধীজি, নেলসন ম্যান্ডেলা, সকলেই প্রায় একাধিক বার থেকেছেন। জেলখানার খানিকটা অংশ অবিকৃত ভাবে রেখে দেওয়া হয়েছে। রাজবন্দি আর সাধারণ অপরাধীদের কী ভাবে একসঙ্গে রেখে দেওয়া হত, কী ভাবে খাবার দেওয়া হত, কোথায় মাসে এক বার স্নান করতে দেওয়া হত— সবই এখন সাধারণের জন্য উন্মুক্ত। আর খানিকটা অংশ ভেঙে, সেই ইট দিয়ে ওই চত্বরেই তৈরি হয়েছে ‘কনস্টিটিউশন কোর্ট’। লম্বা চারটি মানুষের ছায়া আঁকা আছে তার মেঝেতে। এখানে এক সময় বন্দিদের আপনজনেরা অপেক্ষা করতেন। বেলা গড়ালে ক্রমশ তাঁদের ছায়াগুলি লম্বা হয়ে যেত। আমার মনে পড়ে যায় সত্তরের দশকের কলকাতায় লর্ড সিনহা রোডে গোয়েন্দা দফতরে অপেক্ষারত মানুষের উৎকণ্ঠা, অপমান আর ক্লান্তিতে মাখামাখি মুখগুলি। ডারবানের ‘কুয়া মুহলে’ মিউজিয়ামেও অপেক্ষারত সাধারণ মানুষের মূর্তি তৈরি করা আছে। যে বেঞ্চে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন তাঁরা, সেগুলিও সাক্ষ্য হিসেবে সংরক্ষিত হয়েছে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় কিছু দিন বাস করে ও ঘুরে এই সব কিছুকেই গণতন্ত্রের উদযাপন বলে মনে হয়েছে। সে দেশের গণতন্ত্রের বয়স কুড়ি। আমি ভারতের পোড় খাওয়া নাগরিক। ভালই জানি, গণতান্ত্রিকতার মোড়কে রাষ্ট্র কী ভাবে কায়েমি স্বার্থ ও স্বৈরাচারের প্রতিনিধিত্ব করে। দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষও জানতে শুরু করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার এই আয়োজন, ব্যক্তির চেয়ে গণ-আন্দোলনকে বড় করে দেখানোর এবং দেখার এই মানসিকতার কাছে শ্রদ্ধায় নত না হয়ে পারিনি। এই মন যদি ওঁরা বাঁচিয়ে রাখতে পারেন, তা হলে এক দিন হয়তো সত্যিকারের গণতন্ত্রের রূপায়ণ সম্ভব হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন