সম্পাদকীয় ১

যথেচ্ছাময়ী

পৌনে চার বত্‌সর যাবত্‌ আগাগোড়া পশ্চিমবঙ্গ তাহার মুখ্যমন্ত্রীর ছোট-বড় দর্শনের সহিত তাল মিলাইবার চেষ্টা করিয়া চলিতেছে। কোনটিকে তিনি ছোট বলিয়া মনে করেন, কেনই বা মনে করেন, তাহা বুঝিবার আপ্রাণ প্রয়াস করিতেছে। ধর্ষণ হইতে বিনা অপরাধে গ্রেফতার, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গুণ্ডাবাজি হইতে ট্যাক্সিচালকদের যথেচ্ছাচার, সবই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিচারে ছোট ঘটনা, আর তাই রাজ্যবাসী সে সব সহিতে এবং বহিতে বাধ্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০১
Share:

পৌনে চার বত্‌সর যাবত্‌ আগাগোড়া পশ্চিমবঙ্গ তাহার মুখ্যমন্ত্রীর ছোট-বড় দর্শনের সহিত তাল মিলাইবার চেষ্টা করিয়া চলিতেছে। কোনটিকে তিনি ছোট বলিয়া মনে করেন, কেনই বা মনে করেন, তাহা বুঝিবার আপ্রাণ প্রয়াস করিতেছে। ধর্ষণ হইতে বিনা অপরাধে গ্রেফতার, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গুণ্ডাবাজি হইতে ট্যাক্সিচালকদের যথেচ্ছাচার, সবই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিচারে ছোট ঘটনা, আর তাই রাজ্যবাসী সে সব সহিতে এবং বহিতে বাধ্য। কোনও শীর্ষ প্রশাসক বলিতে পারেন যে, ছোটবেলা হইতে তিনি ট্যাক্সি চড়িতেছেন তখন হইতেই দেখিয়া আসিতেছেন ট্যাক্সি যাত্রীদের প্রত্যাখ্যান করিয়া থাকে, সুতরাং প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি নেহাতই ছোট, গুরুতর বলিয়া ভাবিবার দরকার নাই— ইহা অকল্পনীয়। কোনও অন্যায়ের পৌনঃপুনিকতা দ্বারা তাহার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয় না: ইহা সম্ভবত প্রশাসনের প্রথম পাঠসমূহের অন্যতম। বরং দীর্ঘ কাল সংঘটিত অন্যায়কে শক্ত হাতে দমন করিবার ক্ষমতাকেই এত কাল প্র-শাসন অর্থাত্‌ প্রকৃষ্ট শাসন বলিয়া মনে করা হইয়াছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য একক, বিশিষ্ট। কোনও সাধারণ জ্ঞান বা সাধারণ দর্শনের তোয়াক্কা তিনি করেন না। তাঁহার একতান্ত্রিক রাজ্যে প্রশাসনের অর্থ এবং ব্যাখ্যা তিনি ভিন্ন রীতিতে রচনা করেন। তিনি যাহা ভাবেন এবং বলেন, সেইটুকুই তন্নিষ্ঠ সত্য। বাকি সব অলীক।

Advertisement

কলিকাতা শহরের ট্যাক্সিচালকরা যে আচরণে অভ্যস্ত, তাহা গোটা পৃথিবীতেই অ-তুলনীয়। অবশ্য তাহার জন্য পৃথিবী কেমন করিয়া চলে, তাহারও একটা ধারণা থাকা প্রয়োজন। ইউরোপ আমেরিকা দূরস্থান, দক্ষিণ আমেরিকা বা এশিয়ার অন্যান্য দেশেও গণপরিবহণের ক্ষেত্রে কলিকাতার ট্যাক্সির মতো মুখের উপর প্রাত্যহিক ভিত্তিতে প্রত্যাখ্যান করিবার দস্তুর নাই। গণপরিবহণ পরিচালনার সরকারি বা বেসরকারি বন্দোবস্ত অনুযায়ী তাহাদের কিছু নিয়মনীতিও থাকে। কোনও নিয়মনীতি বা দায়বদ্ধতা ছাড়াই কী ভাবে পরিবহণ চলিতে পারে, তাহারও প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত কলিকাতা। তিন হাজার টাকা জরিমানা স্থির করিবার পিছনে নিশ্চয়ই ব্যক্তিবিশেষের খেয়ালখুশি ছাড়াও অন্য কোনও নির্দিষ্ট পদ্ধতি ছিল। জরিমানা এক ধাক্কায় কমাইয়া একশত টাকা করিবার পিছনেও সেই ভাবে, এক জন ব্যক্তির (তিনি যত বড় পদাধিকারীই হউন না কেন) মর্জি ছাড়া একটি দৃষ্টিগোচর পদ্ধতি থাকিলে ভাল হইত। অ্যালিসের কাহিনিতে বর্ণিত ইচ্ছাময়ী রানির কথা মনে পড়িত না।

মূল প্রশ্ন ইহাই। একশত টাকার ভয়ে ট্যাক্সিচালক তাঁহার দুর্ব্যবহার শুধরাইবেন কি না, তাহার অপেক্ষাও বড় দুশ্চিন্তা, যেখানে সমস্ত পদ্ধতি-বিরহিত আচমকা সিদ্ধান্ত, যুক্তিহীন সিদ্ধান্ত লইবার এই স্বীকৃত প্রচলন, সেখানে সমাজের নিয়মভঙ্গকারী গোষ্ঠীগুলির অফুরান আশ্রয় এবং প্রশ্রয় সাদা চোখেই দেখা যায়। যাত্রী-প্রত্যাখ্যান, অতিরিক্ত ভাড়া দাবি কিংবা বেশি রাতে ট্যাক্সি না চালাইবার শাসানি, এগুলি সবই রীতিভঙ্গের এক একটি প্রকরণ মাত্র। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই আরও নূতনতর বেমক্কা প্রকরণ আবির্ভূত হইবে, যাহাতে যাত্রী-সমাজ ত্রস্ততর বোধ করিবেন। আসল কথা, চালক ইউনিয়ন জানেন যে, তাঁহারা নিশ্চিন্ত, রণে বনে আক্রমণে তাঁহাদের রক্ষা করিবার জন্য রহিয়াছে পদ্ধতি-বিমুখ প্রশাসনের অনন্ত বরাভয়। চালক-সমাজ, যাত্রী-সমাজ ইত্যাদি বিভিন্ন স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখিয়া নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে গণপরিষেবা দানই প্রশাসনের কাজ হইবার কথা। পরিবর্তে যদি নেত্রীর মর্জির দাপটে প্রশাসনিক ব্যবস্থা উঠে ও বসে, তবে আলাদা করিয়া অপশাসনের দরকার নাই। ইহাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী অবদান: ‘সিস্টেম’ বিরোধিতার পর্যাপ্ত ইশারার মাধ্যমে তিনি ‘সিস্টেম’কে হুড়মুড় করিয়া ভাঙিয়া যাইতে দিতেছেন!

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement