নরেন্দ্র মোদী বলিতে পারেন, অন্তত এই দফায় তিনি রাষ্ট্রপতির আপত্তিকে অগ্রাহ্য করেন নাই। জাল্লিকাট্টু বিষয়ক অর্ডিন্যান্সটি তামিলনাড়ু সরকার জারি করিয়াছে, কেন্দ্রীয় সরকার তাহাতে অমত করে নাই মাত্র। দেশের সর্বোচ্চ আদালত যে প্রসঙ্গে তাহার রায় ঘোষণা করিবার কথা জানাইয়া রাখিয়াছে, সেই বিষয়টি লইয়া অর্ডিন্যান্স জারি করিবার অর্থ, সুপ্রিম কোর্টের আসন্ন রায়টিকে গুরুত্ব না দেওয়ার কথা ঘোষণা করিয়া দেওয়া। কাজটি করিবার আইনি অধিকার সরকারের আছে। কিন্তু, শিষ্টতার পাঠ বলিবে, গণতন্ত্রের একটি স্তম্ভ যদি অপর স্তম্ভ সম্বন্ধে ন্যূনতম সম্মান প্রদর্শন করিতেও ব্যর্থ হয়, তবে তাহা গণতন্ত্রের অপমান। সংসদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পাশ কাটাইয়া কোনও একটি সিদ্ধান্তকে কার্যকর করিবার প্রবণতাটি বিপজ্জনক। জাল্লিকাট্টুর ন্যায় বিষয়ের ক্ষেত্রে বিপদ আরও বেশি প্রকট। তামিলনাড়ুর এই প্রাচীন খেলার প্রথাটির দিনক্ষণ নির্ধারিত। গত কয়েক বৎসর যাবৎ ঠিক এই সময়েই বিতর্ক তীব্র হইয়া উঠিতেছে। সুতরাং, সংসদীয় প্রক্রিয়ায় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জাল্লিকাট্টু বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছাইবার সুযোগ কেন্দ্রীয় সরকারের ছিল। অন্যথায়, সুপ্রিম কোর্টের রায় প্রকাশ হওয়া অবধি অপেক্ষা করা বিধেয় ছিল। অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টকে অবজ্ঞা করিয়া বিচারবিভাগেরও অসম্মান হইল, আইনবিভাগেরও মানবৃদ্ধি হইল না।
কেহ সন্দেহ করিতে পারেন, ইহা নিছক অপারদর্শিতা নহে, অথবা অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে স্বেচ্ছাচারিতার নিদর্শনও নহে। ইহা রাজনীতির একটি বিশিষ্ট প্যাঁচ। জাল্লিকাট্টুর প্রশ্নটি তামিল খণ্ডজাতীয়তার সহিত অঙ্গাঙ্গি হইয়া আছে। বস্তুত, ক্রমেই দেখা যাইতেছে, শুধু তামিলনাড়ু নহে, সমগ্র দাক্ষিণাত্যেই প্রশ্নটি আঞ্চলিক পরিচিতির উপর হিন্দি বলয়ের আগ্রাসনের সুরে বাজিতেছে। কাজেই, কেন্দ্রীয় সরকার যদি আইন বাঁধিয়া জাল্লিকাট্টুকে নিষিদ্ধ করিবার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, তবে দক্ষিণ ভারতে, বিশেষত তামিলনাড়ুতে, তাহার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া বিজেপি-র পক্ষে ইতিবাচক হইবে না। আবার, সরকার যদি পশুরক্ষা আইন সংশোধন করিয়া জাল্লিকাট্টুকে ছাড়পত্র দেয়, তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে পশুহত্যার বিরুদ্ধেও কথা বলিবার উপায় থাকিবে না। প্রতি বৎসর কুরবানি ঈদের পূর্বে যে রাজনৈতিক আবেগের স্রোত বহিয়া যায়, সেই খাতটিও নীতিগত ভাবে শুকাইয়া যাইবে। প্রশ্ন উঠিবেই, বিনোদনের জন্য যদি পশুক্লেশ মানিয়া লওয়া যায়, ধর্মের জন্য অথবা খাদ্যাভ্যাসের জন্য তাহা না মানিবার কোনও কারণ আছে কি? এই প্রশ্নটির উত্তর না থাকিলে নাগপুরের ঘোরতর অসুবিধা। ফলে, জাল্লিকাট্টুর প্রশ্নে কোনও নির্দিষ্ট অবস্থানে পৌঁছনো নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে কঠিন।
তাহার অপেক্ষা এই সিদ্ধান্তহীনতা ভাল। জন-আবেগের দোহাই দিয়া অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটির আয়োজন নিশ্চিত করাও হইল, আবার তাহার পক্ষে নীতিগত অবস্থান গ্রহণের দায়টিও এড়ানো গেল। কেহ বলিতেই পারেন, নরেন্দ্র মোদী এই খেলাটিই খেলিতেছেন। নচেৎ, আড়াই বৎসর সময়কাল জাল্লিকাট্টু বিষয়ে কোনও নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছাইবার পক্ষে নেহাত কম নহে। খেলাটি বিপজ্জনক। পশুক্লেশ সম্বন্ধে কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করিতেছে, এবং তাহা গোপন করিবার জন্য সংসদীয় গণতন্ত্রের সম্মানহানি করিতে দ্বিধা করিতেছে না, সর্বোচ্চ আদালতের সম্মানরক্ষা লইয়াও সরকারের মাথাব্যথা নাই, কথাগুলি গণতন্ত্রের পক্ষে মারাত্মক। রাজনীতির পক্ষেও ভাল নহে। যথেষ্ট ‘আবেগ’ দেখাইতে পারিলেই যে কোনও দাবি আদায় করিয়া লওয়া যায়, এমন বার্তা ভারতের রাজনীতিরও উপকার করিবে না।