অটলবিহারী বাজপেয়ীকে ভারতরত্ন দেওয়ার প্রস্তাব বিবেচনা করছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। এই খবরটি শুনে শোরগোল পড়ে গিয়েছে গোটা দেশ জুড়ে। মায়াবতী প্রশ্ন তুলেছেন, কাঁসিরামকে কেন ভারতরত্ন দেওয়া হবে না? ১৯৮৮ সালে এম জি রামচন্দ্রনকে ভারতরত্ন দেওয়া হয়েছিল। নেতাজিকে মরণোত্তর ভারতরত্ন দিতে চেয়েছিলেন নরসিংহ রাও। কিন্তু তাতেও রাজনীতির গন্ধ পেয়ে ফরওয়ার্ড ব্লক রে রে করে উঠেছিল। আদালতের দ্বারস্থ হয়ে সে যাত্রা নেতাজিকে মরণোত্তর সম্মান দেওয়া থেকে সরকারকে বিরত করতে সক্ষম হয়েছিল ফরওয়ার্ড ব্লক। ফরওয়ার্ড ব্লক নেতাদের যুক্তি ছিল: নেতাজিকে এই সম্মান দেওয়ার অর্থ তাইহোকু বিমানবন্দরে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল, এ কথা স্বীকার করে নেওয়া। জাপান অনেক দিন থেকেই রেনকোজি মন্দিরে রাখা নেতাজির অস্থিভস্ম ভারতে ফেরত পাঠাতে চায়। নরসিংহ রাও উদ্যোগী হয়েও পিছিয়ে এসেছিলেন। নরেন্দ্র মোদী কি আবার উদ্যোগী হবেন?
আজ শাহি সমাচারে আমার আলোচনার বিষয় ভারতরত্ন প্রদান নয়। ভারতরত্ন প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্র আসলে কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে, সেটাই আসলে বোঝার চেষ্টা করছি। আসলে এক একটি প্রাতস্মরণীয় চরিত্র একটি দেশ, একটি রাজ্য, এমনকী এক একটি প্রান্তের মানুষকে আত্মপরিচয় দেয়। রবীন্দ্রনাথ একে বলেছিলেন, চারিত্রপূজা। জনসমাজের একটি বড় অংশ সুনির্দিষ্ট একটি মানুষের প্রতি তার নিজের আবেগকে যুক্ত করে যখন রাষ্ট্র তাঁকে সম্মান দেয়। এক ধরনের জাত্যাভিমান লাভ করে মানুষ। আমেরিকা ও লিঙ্কন, ভারত ও গাঁধী, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও লেনিন— এ সব চরিত্র নানা ভাবে নানা সময়ে নানা জাতির ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছে। আবার কখনও কখনও জাতির মহানায়ক স্বৈরাচারী হয়ে উঠলে মানুষও শ্রদ্ধা বিসর্জন দিয়ে তাকে ঘৃণার পাত্র করে তুলেছে। যেমন হিটলার বা স্তালিন।
শুধু ভারতরত্ন দেওয়া নয়। রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদানের মধ্যেও মানুষের মন জয় করার বিশেষ ভাবমূর্তি অর্জনের রাজনীতিও থাকে। শুধু ভারতরত্ন কেন, নরেন্দ্র মোদী যখন বল্লভভাই পটেলের ধাতব মূর্তি গড়ার কথা বলেন, তখনও তার মধ্যে একটা রাজনীতির অঙ্ক তো আছেই। প্রথমত, পটেলও গুজরাতি ছিলেন। নেহরু পটেলের মতান্তর সুবিদিত। মৃত্যুর এক ঘণ্টা আগেও নেহরু ও পটেলের বিবাদ মিটিয়েছেন গাঁধী। কংগ্রেস প্রায় এক শতাব্দী ধরে নেহরুবাদী সমাজতন্ত্রকে ভারতীয় রাজনীতির প্রধান চালিকা দর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। পটেলের মূর্তি গড়ে এক অ-কংগ্রেসি দর্শনও নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদী।
আমার যেটা মনে হয়, সেটা হল কোথাও একটা রাজনৈতিক দলের চাপিয়ে দেওয়ার একটা রাজনীতি কাজ করে এই ধরনের ‘আমরা-ওরা’ সংস্কৃতির মধ্যে। ভারতের কোনও রাজনৈতিক দলই এই অসুখটি থেকে মুক্ত নয়। এর মধ্যে এক ধরনের স্বৈরতন্ত্র রয়েছে যা সব সময়ই হিটলারের ফ্যাসিবাদের মতো প্রকট নয়। পিটার অ্যাকরয়েডের কিছু দিন আগে প্রকাশিত চার্লি চ্যাপলিনের জীবনীটি সম্প্রতি পড়ছিলাম। এই জীবনীটি পড়তে গিয়ে জানতে পারলাম, চ্যাপলিন ও হিটলার ১৮৮৯ সালের এপ্রিল মাসে মাত্র চার দিনের ব্যবধানে জন্মেছিলেন। দু’জনের মধ্যে অনেক স্বভাবগত সাদৃশ্য ছিল। চ্যাপলিনের ‘গ্রেট ডিক্টেটর’ ছবিটি হিটলার জার্মানিতে নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু নিজে তিন বার ছবিটি দেখেছিলেন। দেখার সময় সেখানে কাউকে থাকতে দেননি। গ্রেট ডিক্টেটর ছবিতে একটা দৃশ্য ছিল যেখানে চূড়ান্ত ব্যস্ত দিনের মধ্যে মাঝে মাঝেই চ্যাপলিন একটি ঘরে ঢুকে পড়ছেন। সেখানে দাঁড়িয়ে ‘পোজ’ দিচ্ছেন। এক জন ভাস্কর ও এক জন চিত্রশিল্পী তাঁকে দেখে মূর্তি ও ছবি তৈরি করে চলেছেন। কয়েক মুহূর্তের জন্য স্ট্যাচু-র মতো দাঁড়িয়ে গ্রেট ডিক্টেটর নিজেই ঘোষণা করছেন, এনাফ। যথেষ্ট। বলেই আবার অন্য কাজে চলে যাচ্ছেন। বার বার হতাশ হয়ে পড়ছেন চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর। চার্লি সৃষ্টি করেছিলেন তোমানিয়া দেশের গ্রেট ডিক্টেটর অ্যাডেনয়েড হিঙ্কেলকে। কিন্তু চার্লি সম্পর্কে তাঁরই জীবনীকার বলেছেন: ব্যক্তিগত জীবনে চার্লিও স্বৈরাচারী ছিলেন। স্টুডিওতে তিনি কারও কথা শুনতেন না। ভীষণ আধিপত্যকামী ছিলেন।
অ্যাডলফ হিটলারের মন নিয়ে একটি বিরল বই রয়েছে। ওয়াল্টার লাঙ্গার এক জন মনস্তত্ববিদ। তিনি এই বইটিতে শুধুমাত্র হিটলারের মনস্তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। বইটিতে তিনি দেখিয়েছেন, খুব ছোটবেলা থেকেই হিটলার হাস্যরস পছন্দ করতেন না। ওঁকে নিয়ে কেউ মজা করলে তাতেও তিনি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হতেন। আসলে এক দিকে যে রকম মহান চরিত্রকে মানুষ পুজো করে, অন্য দিকে অনেক সময় বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেও একটা মানুষ স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে।ব্যক্তি পুজোর এই প্রবণতা দেশে দেশে ভিড়ের মনস্তত্ত্বে কাজ করতে চলে। যখন আজকের কোনও রাজনৈতিক নেতা অতীতের কোনও রাজনৈতিক চরিত্রকে মহাফেজখানা থেকে বের করে মানুষের সামনে নিয়ে আসেন, তাঁকে ভারতরত্ন দিয়ে বা আড়াই হাজার কোটি টাকা দিয়ে মূর্তি গড়েন, তখন ওই একই মনস্তত্ত্ব কাজ করে। মস্কোতে স্তালিন একদা গোটা জাতির সমার্থক শব্দ ছিলেন। তাঁর বিরোধিতার ঝড়ও রাশিয়া দেখেছে। কিছু দিন আগে রাশিয়াতে গিয়ে আবার দেখলাম, পুতিন আবার স্তালিনকে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন। যাকে বলা হচ্ছে, ‘রি-স্টালিনাইজেশন’। পুতিন এক শক্তিশালী জাতি গঠনের চেষ্টা করছেন। তাই স্তালিনকে ফিরিয়ে আনছেন পুতিন।
ভারতরত্ন নেতাজিকে দেওয়া হবে না মদনমোহন মালব্যকে, তা নিয়ে রাজনৈতিক লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে। নেহরুকে জীবন্ত অবস্থায় ভারতরত্ন দেওয়া হয়েছিল। ইন্দিরা গাঁধীও ভারতরত্ন পেয়েছেন। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন সেই দলের নেতাদের ভারতরত্ন দেওয়ার চেষ্টা হয়। ভগৎ সিংহ, রাজগুরু, সুখদেও, লালা লাজপৎ রাইয়ের নাম প্রস্তাব করেছেন কংগ্রেসের মণীশ তিওয়ারি। নীতীশ কুমার-লালুপ্রসাদ মিলে দাবি তুলেছেন, জয়প্রকাশ নারায়ণকে দেওয়া হোক। কাকে ভারতরত্ন দেওয়া হবে বা কার মূর্তি গড়া হবে, সেটা মূল প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হল, গাঁধীজি বা নেতাজির মতাদর্শ কোথায় গেল? নেতাজি বলেছিলেন, শ্রমিক, কৃষক, মহিলা সব থেকে অবহেলিত শ্রেণি। এ জন্য কমিউনিস্ট হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আমি এক জন সাধারণ ভারতীয় নাগরিক। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। সেই ভারতীয়দের নেশাগ্রস্ত করে রাখার লক্ষ্যে রাজনৈতিক নেতাদের এটাও একটা কৌশল। ভারতীয় নাগরিকের হাতে থাকছে সেই পেনসিল। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় স্পিকার হিসেবে বলেছিলেন, যথেষ্ট স্ট্যাচুতে সংসদ ভরে গিয়েছে। আর রাখা যাচ্ছে না। কিন্তু আসলে কিছুই বন্ধ হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, যদি স্মরিতে হয় মন, ডেকো না ডেকো না সভা। এসো হে ছায়ায়, যেথা চৈত্রের শালবন। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ওঁর কোনও মূর্তি স্থাপন করতে দেননি। পুজোর ছলে ভুলে থাকতে বারণ করেছিলেন। এই ভুলে থাকা থেকে বের করে আনার দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতাদের।
কিন্তু যাতে ভুলে থাকতে পারি, বাস্তবে সেই ব্যবস্থাই হচ্ছে!