সুইসাইড বম্বাররা আসার আগে, পৃথিবীতে সবচেয়ে মহান লোক ছিল কে? যে নিজের প্রাণ দিতে ডরায় না। দেশের জন্যে প্রাণ দিলে গলির ধারে শহিদ বেিদ, প্রেমের জন্যে প্রাণ দিলে চিরকাল স্বামীকে লুকিয়ে প্রেমিকা আঁচলে চোখ মুছুমুছু। আদর্শের জন্যে আত্মাহুতি দেওয়ার আগে কেউ বলত ‘বন্দে মাতরম্’, কেউ জল্লাদকে ভেংচি কাটত আধ হাত জিভ বের করে। সবাই শিউরে উঠত, কী মৃত্যুঞ্জয়ী ঢিশুম! আর আমি যেই কেরোসিনের বোতল হাতে হুমকি দিলাম, পুলিশ আর এক পা এগোলে আত্মহত্যা করব, বিয়েবাড়ি আর মেলা ভাড়া দেওয়ার এই জমির দখল নিতে গেলে আমার লাশের ওপর দিয়ে এগোতে হবে— কোথায় রাজ্যময় হাততালি ও ফোঁৎ ফোঁৎ অশ্রুর বান ডেকে যাবে, লোকে বলবে অগ্নিযুগ ফিরে এসেছে হাহাগো, দেউলিয়াপনার এই দিনকালে বিবাদী বাঘের মতো আলোকময় ইস্পাতপুরুষকে দেখে সবার ইতিহাস বই চড়কগাছ হয়ে যাবে, আমায় দেখার জন্যে লাইন পড়বে আর টিকিট হবে মিনিমাম সাড়ে তিনশো, তা না, মিডিয়া আমার বিরুদ্ধে চলে গেল! মানুষ আমার মতো হিরো ছেড়ে দিলওয়ালে নিয়ে কথা বলল!
আইন! আইন দেখাচ্ছে! কত বড় একটা কথা বলেছি আমি: মানুষের জন্যে কোর্ট না কোর্টের জন্যে মানুষ! এ রকম আর একটা কী ধাঁধা আছে না? খাওয়ার জন্যে বাঁচা না বাঁচার জন্যে খাওয়া? অবশ্যই খাওয়ার জন্যে বাঁচা। বিয়েবাড়িতে খাওয়ানো হয়, মেলাতেও। বিয়ে ডিভোর্সের চেয়ে ভাল, প্যান্তাখ্যাচাং চচ্চড়ির চেয়ে নেমন্তন্নর ফিশফ্রাই ভাল, ন্যাড়া জমির চেয়ে এক দিকে বিয়েবাড়ির হুল্লোড় অন্য দিকে মেলার স্টলের রংবেরং ভাল, আমার হাত ফাঁকা থাকার চেয়ে পয়সায় উপুড়জুপুড় হওয়া ভাল, তৃণমূল ক্ষমতায় এলে পাড়ার ওস্তাদের রমরমা হওয়া ভাল। সেই ভালর, সুন্দরের, সনাতন সত্যের পরিমাণ বাংলায় বাড়াতে চাই, এই কি আমার অপরাধ? চারিদিকের দুঃখকষ্টের মধ্যে উৎসব অহরহ পেখম মেলুক— চাওয়াটা কি ক্রাইম? তাই কি আজ আমায় সিস্টেমের কাছে গাঁট্টা খেতে হচ্ছে?
না, কথাটা সিরিয়াসলি ব্যাখ্যা করি, তাইলে এর কোটেশন-স্টেটাস নজরে আসবে। মানুষকে আইন মেনে চলতে হয়, নিশ্চয়ই, কিন্তু তার মানে কি মোটকা বইয়ের হাবিজাবি ফুটনোটগুলো মানুষের পাঁজরার ওপর দিয়ে রোডরোলারের নিষ্ঠুরতায় দলে যাবে! আইন বদলাবার জন্যে আন্দোলন হয় না? মেয়েদের জন্যে নতুন আইন হয়নি? জুভেনাইলকে যখন আইন মেনে ছেড়ে দেওয়া হল তার বিরুদ্ধে মিছিল বেরোয়নি? তা হলে? মানুষের কথা ভেবে, প্রতিটি কেসের ইতর-বিশেষ ওজন করে দেখতে হবে। সব সময় পাড়ার দাদাকে ইতর আর বড়লোক মালকিনকে বিশেষ বলে ভাবলে চলবে কেন? একটা লোকের নামে জমি থাকলেই তাকে দিয়ে দিতে হবে? তা হলে বিপ্লবের সময় জোতদারের আইনসিদ্ধ জমি কেড়ে সর্বহারার মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয় কোন নীতিতে? সিপিএম জমিদারদের জমি নিয়ে বর্গাচাষিদের দিয়ে দিয়েছিল কোন যুক্তিতে?
প্রাইভেট প্রপার্টির এই আইন তো আসলে কিছু লোকের হাতে সব আনন্দ জড়ো করার আইন। আর অনেক বেশি লোকের কপালে অনেক বেশি দুঃখ লেখার আইন। আমি আমার জমি কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দেব, অন্য লোকের মর্নিং ওয়াক আটকে দেব, ফুল কুড়োনো বন্ধ করে দেব, আমার জমিতে আম জাম পড়ে পচে নষ্ট হবে, তবু গরিবকে তা পাড়তে দেব না, কাঠকুটো নিয়ে বাড়ি গিয়ে জ্বালিয়ে শীতে শরীর সেঁকতে দেব না, এই তো মোটো? এই অনুশাসন তো স্বার্থপর দৈত্যের। এ নোটিস তো কুৎসিত ও পুঁজিপুঁজাক্রান্ত। এরই বিরুদ্ধে লাখো প্রবন্ধ, কোটি সিনেমা, সাহিত্য। শুধু সেগুলো আগেকার যুগে তৈরি বলে আমাদের কাছে নমস্কারম্যান, আর আমি এখনকার ফাতরা সময়ে দাঁড়িয়ে কথাটা দাবড়াচ্ছি বলে, আমি কমেডিয়ান।
আসলে এই যুগে বাজারের প্রতি একটা সাংঘাতিক সাষ্টাঙ্গ পেন্নাম গজিয়েছে। আগে সমাজ গরিবের দিকে হেলে থাকত। বড়লোকের ওপর খেরে থাকত। এখন উলটো। মালকিনকে জমি পাইয়ে দেওয়ার জন্যে সব দল বেঁধে ফাল পাড়ছে! আরে ওই পুঁজিপতির যদি অ্যাদ্দিন জমি ছাড়া চলে, তো আরও দুশো বছর চলবে। তা ছাড়া, যদি তোদের অন্যের সম্পত্তির প্রতি অতই শ্রদ্ধা, এই বিয়েবাড়ি আর মেলার ভাড়া কালেক্ট করে আমার সম্পত্তি তরতরিয়ে বাড়ছে বলে তোরা গোটা রাজ্য মিলে নজর দিচ্ছিস কেন র্যা?
ঠিকই, ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রতি কিছুটা সমীহ আমারও আছে, মানে আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রতি। তাই নিয়ে, মানে এই ভাড়ার পয়সার বখরা নিয়ে ক্লাবের সঙ্গে চুলোচুলিও করেছি আগে। কিন্তু এখন ব্যাপারটা মানবসমাজের দিকে ঘুরে গেছে। মাইরি। তাই তো বিয়েবাড়ি-ফাড়ি ছেড়ে, পুরোটাকে খেলার মাঠের অধিকার আর সবুজ বাঁচাও আন্দোলনের অ্যাঙ্গল দিয়েছি। এমনকী বাতেলা-সরণি ছেড়ে এ কথাও বলেছি, ‘আইন আইনের পথে চলবে।’ ওটা আমাদের একটা লব্জ। ওর মানে হচ্ছে, এখন চেপে যাও, ওপর-লেভেল থেকে কোঁতকা এসেছে। ঠিকই, আইন যদি আইনের পথেই চলে, তা হলে আর আইনকে পথ থেকে উপড়ে ফেলার হুমকির মানে কী হল? কী বলব, এই মিডিয়া এমন শয়তান না, সারা ক্ষণ ফুসুরফুসুর করে কান ভাঙিয়ে বড় বড় মনীষীরও ঘিলুটা ঘুলিয়ে দেয়। তাঁরা হয়তো তখন আজকের রাজাকে কাল থেকে ফকিরের নালায় ঝেড়ে ফেললেন। অনেকেরই তো দশা দেখলাম। সে রকমটা সত্যি হলে, আর ফাঁকা হুমকি নয়, কেরোসিনের বোতলটা হয়তো সত্যিই ইউজ করতে হবে। আরও ট্র্যাজেডি, তখন ডাকলে পাঁচশোটা ছেলে কোরাসে কেরোসিন নিয়ে হাজির হবে না। সত্যিই তো, পার্টির জন্য হিরো না হিরোর জন্য পার্টি?
লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়