সম্পাদকীয় ২

শৈত্যপ্রবাহ

এই গ্রহের কিছু কিছু অঞ্চল আছে, যেখানে ঋতুনির্বিশেষে সারা বত্‌সর ‘শৈত্যপ্রবাহ’ চলিতেই থাকে। ইউক্রেন তেমনই একটি অঞ্চল। এক দিকে রাশিয়ার মতো আপাদমস্তক পরমাণু অস্ত্রসজ্জিত মহাশক্তি, আর এক দিকে ইউরোপের অন্যান্য বৃহত্‌ শক্তিসমবায়ের মধ্যে অবস্থিত ইউক্রেনে ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’ শেষ হয় নাই, কোনও দিন শেষ হইবে এমন আশাও কম।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০১
Share:

এই গ্রহের কিছু কিছু অঞ্চল আছে, যেখানে ঋতুনির্বিশেষে সারা বত্‌সর ‘শৈত্যপ্রবাহ’ চলিতেই থাকে। ইউক্রেন তেমনই একটি অঞ্চল। এক দিকে রাশিয়ার মতো আপাদমস্তক পরমাণু অস্ত্রসজ্জিত মহাশক্তি, আর এক দিকে ইউরোপের অন্যান্য বৃহত্‌ শক্তিসমবায়ের মধ্যে অবস্থিত ইউক্রেনে ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’ শেষ হয় নাই, কোনও দিন শেষ হইবে এমন আশাও কম। ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার আগ্রাসন যে শান্তিচুক্তি দ্বারা বন্ধ হইয়াছিল, তাহা নেহাতই প্রসাধনী মাত্র। ক্রাইমিয়া দখলের পরও রুশ ক্ষমতা প্রসারের আকাঙ্ক্ষা কোনও মতে কমে নাই, আরও কোন কোন পথে অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধা এই ক্ষুদ্রকায় দেশটি হইতে সংগ্রহ করা যায়, তাহার সাধনা চলিতেছেই। হাজার হউক, মাত্র পঁচিশ বত্‌সর আগে ইউক্রেন রাশিয়ারই নিজস্ব অংশ অর্থাত্‌ উপনিবেশ ছিল। ঠিক সেই কারণেই ইউক্রেনেরও রুশ-বিরোধিতার ধারা সমানেই অব্যাহত। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙিয়া যাইবার পর পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন ঘটিয়া গিয়াছে, কেবল রুশ রাষ্ট্রীয় মানসিকতায় তেমন পরিবর্তন আসে নাই: এখনও ক্রেমলিনের মনোজগতে পূর্ব ইউরোপের স্লাভিক দেশগুলি তাহার নিজস্ব, একান্ত নিজস্ব, সম্পত্তিমাত্র বলিয়া ভ্রম হয়। এই ভ্রম যত দিন থাকিবে, শৈত্যপ্রবাহ বন্ধ হওয়াও অসম্ভব।

Advertisement

ব্রাসেলস-এ এ বারের ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাউন্সিলের সভায় সেই শৈত্যপ্রবাহ বিলক্ষণ অনুভূত হইল। ইউক্রেনীয় প্রধানমন্ত্রী ইয়াতসেনিয়ুক বলিষ্ঠ দাবি পেশ করিলেন যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ হইতে তাঁহার দেশ এখনই, যত দ্রুত সম্ভব, অর্থনৈতিক সহায়তা প্রত্যাশা করে। রাশিয়ার মতো আক্রমণাত্মক দেশের প্রতিবেশী হিসাবে ইউক্রেনকে যদি আদৌ বাঁচিতে হয়, তাহা হইলে এই অর্থসহায়তা জরুরি। অর্থাত্‌ কেবল ইউক্রেনের নিজস্ব উন্নয়নের জন্যই নহে, রাশিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব হইতে ইউক্রেনকে মুক্ত রাখিবার পথও ইইউ-এর সহায়তা চাহিবার কারণ। ঠিক এইখানেই শীতল যুদ্ধের নবমঞ্চটি নির্ধারিত। ইইউ-এর কাউন্সিলের বৈদেশিক বিষয়ের সচিব আশ্বাস দিয়াছেন যে গত এক বত্‌সরে যেমন ইইউ-এর অর্থসাহায্য ইউক্রেনের জন্য অবারিত থাকিয়াছে, এখনও তেমনই থাকিবে। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার হইতেও বিপুল পরিমাণ সহায়তা এবং বিপুলতর সহায়তার প্রতিশ্রুতি আসিতেছে। আসিতেছে প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ের প্রকরণ হিসাবেই। শৈত্য-তরঙ্গের অভিঘাতে।

এই বৈঠকে ইইউ এবং ইউক্রেনের আর একটি গুরুতর বোঝাপড়াও হইল। তাহা মুক্ত বাণিজ্যের বোঝাপড়া। মনে রাখিতে হইবে, ইইউ-এ সহিত মুক্ত বাণিজ্যের সিদ্ধান্তটি লইতে পূর্বতন মস্কো-অনুগামী প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ পিছ-পা হইয়াছিলেন বলিয়াই ইউক্রেনীয় দাঙ্গার সূত্রপাত হইয়াছিল, যাহার ফল হিসাবে পুতিন ক্রাইমিয়া দখল করেন। ক্রেমলিনের পক্ষে ইউক্রেন ও ইইউ-এর মুক্ত বাণিজ্য সম্পর্ক স্বীকার করা কেবল কঠিন নহে, রীতিমতো ত্রাসজনক। তাহার নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থের পক্ষে বিপজ্জনকও। সুতরাং এই বারের বৈঠকের সিদ্ধান্ত শুনিয়া রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন স্বভাবতই ক্রুদ্ধ হুঙ্কার ছাড়িয়াছেন। তাঁহার হুঙ্কার সাধারণত শূন্যগর্ভ হয় না। সুতরাং ইউক্রেনের সম্মুখে সম্ভবত কঠিন সময়। এক দিকে ইইউ-এর মুক্ত বাণিজ্য সম্পর্কের আশ্বাস, অন্য দিকে মস্কোর প্রবল প্রতাপ স্বীকারের বাধ্যবাধকতা। শীতল যুদ্ধ কি ফিরিল?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement