দুর্নীতির খনি? ঝরিয়া, ফেব্রুয়ারি ২০১২। ছবি: গেটি ইমেজেস
চলতি লোকসভা নির্বাচনের মূল প্রশ্ন কী, তা নিয়ে খানিক ধন্দে আছি। এক বার মনে হচ্ছে, কোন পথে ভারতকে ফের বছরে নয় শতাংশ আর্থিক বৃদ্ধির হারে পৌঁছে দেওয়া যায়, সেটাই বুঝি আলোচনার কেন্দ্রে। পরমুহূর্তেই আবার দুর্নীতির প্রশ্ন এসে আড়াল করে দিচ্ছে সেই তর্ককে। কিন্তু একটা কথা পরিষ্কার— এত বছর ধরে ভারতীয় রাজনীতি যে ‘রোটি-কাপড়া-মকান’-এর কক্ষপথে ঘুরত, এই নির্বাচন সেই চেনা ছক থেকে বেরিয়ে এসেছে। সকলের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলি ইতিমধ্যেই মিটেছে কি না, সেই প্রশ্ন আপাতত থাক। আর্থিক বৃদ্ধির হার নিয়ে বহু আলোচনা হচ্ছে। ইউপিএ-র আমলের সঙ্গে এনডিএ-র তুলনা, নরেন্দ্র মোদীর মডেলের কাটাছেঁড়া— গত এক-দেড় মাসে বহু নিউজপ্রিন্ট আর এয়ারটাইম দখল করেছে এই আলোচনাগুলো। কিন্তু, দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা সে তুলনায় প্রায় হয়নি বললেই চলে। তবুও কেন দুর্নীতির প্রশ্নটি এই লোকসভা নির্বাচনের একেবারে কেন্দ্রে ঠাঁই পেল, সে প্রসঙ্গে কয়েকটা কথা বলার চেষ্টা করব।
হাতের কাছে যাঁকে পাবেন, তাঁকেই একটা প্রশ্ন করে দেখুন— ইউপিএ সরকারের সবচেয়ে বড় খামতি কী? দশ জনের মধ্যে অন্তত আট জন বলবেন, দুর্নীতি। কিন্তু সেই দুর্নীতি ঠিক কোথায়, এই প্রশ্নের যথার্থ উত্তর পাবেন না, বাজি ধরতে রাজি আছি। বড় জোর শুনবেন, কয়লাখনি বণ্টন কেলেঙ্কারি, টু জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি। আমাদের মতো আমজনতার কাছে এর বেশি বিস্তারিত তথ্য থাকবে না, সেই প্রত্যাশিত। কিন্তু, কয়লাখনি বণ্টনে ঠিক কোথায়, কোন গোত্রের দুর্নীতি হয়েছে, সেই প্রশ্নের উত্তর প্রায় কোথাও মিলবে না। যে সিএজি রিপোর্ট থেকে এই বিতর্কের সূচনা, সেখানেও কয়লাখনি বণ্টনের আইনের ধোয়াশার কথা বলা হয়েছে। কোন বেসরকারি সংস্থার দাবি অন্যদের তুলনায় প্রাধান্য পাবে, তার একটা নিয়ম আছে। যেমন, ইস্পাত বা বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থাগুলি অগ্রাধিকার পাবে; বড় পুঁজির সংস্থা ছোট সংস্থার তুলনায় বেশি গুরুত্ব পাবে; যে প্রকল্পের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে, তার দাবি নতুন প্রকল্পের তুলনায় বেশি হবে ইত্যাদি। কিন্তু বড় পুঁজির সংস্থার নতুন প্রকল্পের সঙ্গে ছোট পুঁজির সংস্থার অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া প্রকল্পের মধ্যে কোনটি অগ্রাধিকার পাবে, সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া দুরূহ।
এবং, এই সিএজি রিপোর্টের মূল প্রতিপাদ্য হল, ২০০৫ সালে ইউপিএ সরকার যে কয়লাখনি বণ্টন করেছিল, সেটা নিলামের মাধ্যমে করলেও কোনও আইনি বাধা ছিল না, কিন্তু তা না করে সরকার স্ক্রিনিং কমিটির মাধ্যমে কাজটি করে। সিএজি কিন্তু কোনও দুর্নীতির কথা বলেনি। বলার কারণও নেই। নিলামের মাধ্যমে বণ্টন করা যেত কি না, তা নিয়ে সিএজি রিপোর্টেই অন্যত্র কিছু সংশয় রয়েছে। এবং, কয়লাখনি বণ্টনের সিদ্ধান্ত যে কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর নির্ভরশীল নয়, তাতে বিভিন্ন রাজ্য সরকারের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, সে কথাও ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভূগর্ভে কয়লা রয়েছে, এমন সাতটি রাজ্যকে নিজেদের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। দিনকয়েক আগেই উত্তরপ্রদেশের মুখ্যসচিবকে জেরা করল সিবিআই। অর্থাৎ, দুর্নীতির এই আখ্যানটি সরলরৈখিক নয়। তার বহু স্তর, বহু মাত্রা, বহু অভিলম্ব।
ইউপিএ সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত নয়, অথবা কংগ্রেসের হাতে কখনও কোনও বেনিয়মের কলঙ্ক লাগেনি, এমন দাবি করার জন্য এই লেখা লিখছি না। তদন্ত চলছে। কাল না হোক পরশুর পরের দিন নিশ্চয়ই জানা যাবে, কোথায় কার কতখানি দোষ ছিল। এই লেখায় শুধু বলতে চাইছি, দুর্নীতি এক কথা, আর জনপরিসরে সেই দুর্নীতির পুনর্নির্মাণ সম্পূর্ণ অন্য কথা। কয়লাখনি বণ্টনের প্রসঙ্গটি নেহাত উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করছি। তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ। পদ্ধতিগত প্রশ্ন, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের প্রশ্ন, আইনি জটিলতার প্রশ্ন— সব ছাপিয়ে যেমন উঠে এল একটিই কথা— কয়লাখনি বণ্টনে অনিয়ম হয়েছে, এবং তার জন্য দায়ী কেন্দ্রের কংগ্রেসি সরকার। এই যে একটা বহুমাত্রিক ঘটনা শেষ পর্যন্ত একমাত্রিক আখ্যানে পরিণত হল, তাতে গণমাধ্যম এবং প্রচারের ভূমিকা খেয়াল করার মতো। যে কোনও জটিলতাই সর্বজনের পক্ষে দুষ্পাচ্য। ফলে, জটিলতা থেকে সহজ গল্প তৈরি করে আনার কাজটা মিডিয়া নিয়মিত করে থাকে। ঠিক যে ভাবে অমর্ত্য সেন আর জগদীশ ভগবতীর তর্ক মিডিয়ার হাত ঘুরে পরিণত হয় দুই দিকপালের কংগ্রেস আর বিজেপি-কে সমর্থন জোগানোর আখ্যানে, তেমনই দুর্নীতির বহুমাত্রিক গল্পটি পরিণত হয় এক খলনায়ক বনাম এক নায়কের লড়াইয়ে। খলনায়ক কংগ্রেস। আর নায়ক? নরেন্দ্র মোদী, অবশ্যই।
সরল গল্পের প্রতি এমন তীব্র আকর্ষণ না থাকলে গোটা ছবিটা হয়তো একটু অন্য চোখে দেখা সম্ভব হত। প্রথমত, দুর্নীতি জিনিসটা ভারতে নতুন নয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি সংস্থা প্রতি বছর একটি সূচক প্রকাশ করে— করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স। বিশ্বের প্রায় সব দেশে সমীক্ষা করে মাপা হয়, কোন দেশের মানুষ নিজেদের দেশকে কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করেন। সেই সূচকে দেখা যাচ্ছে, ইউপিএ ক্ষমতায় আসার আগেও দুর্নীতির মাপকাঠিতে গোটা দুনিয়ায় ভারত যে জায়গায় ছিল, ইউপিএ-র শাসনের শেষে তার চেয়ে খানিক পিছিয়েছে বটে, কিন্তু খুব তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে নয়। দুর্নীতি নিয়ে মিডিয়ায় এবং বিরোধীদের প্রচারে যে তুমুল হইচই আরম্ভ হয়েছে, এই ছবিটা তার সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না। এবং সেই কারণেই, হইচইটা নিয়ে একটু সতর্ক থাকা ভাল।
দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি বাড়লেই তার দায় যে কেন্দ্রীয় সরকারের, তা-ও তো নয়। এক দিকে, সাধারণ মানুষ প্রতি দিন যে দুর্নীতির শিকার হন, এবং যে দুর্নীতি করেন, তা ছোট মাপের দুর্নীতি। পুলিশের ঘুষ খাওয়া, সরকারি দফতরে ফাইলের স্থিতিজাড্য ভাঙতে টেবিলের নীচ দিয়ে কিছু আদানপ্রদানের মতো দুর্নীতি। এতে মানুষের তীব্র রাগ হয়, দুর্নীতির ‘পারসেপশন’-ও বাড়ে, কিন্তু এই দুর্নীতির দায় কোনও সরকারের ঘাড়ে চাপানোই মুশকিল। কিন্তু, যখন মিডিয়া কোনও এক খলনায়ককে চিহ্নিত করে দেয়, তখন এই দুর্নীতির রাগও তার ওপর গিয়ে পড়তেই পারে। তার পর রাজনীতি সেই রাগকে বিচিত্র ভাবে ব্যবহার করে, কিন্তু সেটা অন্য প্রশ্ন। এখানে শুধু এটুকু বলার, এই খুচরো দুর্নীতির দায় কেন্দ্রীয় সরকারের নয়। অন্তত, সম্পূর্ণ নয়।
আরও এক গোত্রের দুর্নীতি হয়, যেটা আপাতদৃষ্টিতে খুচরো, কিন্তু সম্মিলিত ভাবে বিপুল। ভারতের শাসন ব্যবস্থাটি, শত দোষ সত্ত্বেও, বেশ বিকেন্দ্রিত। বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, সেই বিকেন্দ্রিত ব্যবস্থায় যত নীচের দিকে নামা যায়, ততই হিসেব দেওয়ার দায় কমে, এবং চুরির বহর বাড়ে। গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনার টাকা যে ভাবে নয়ছয় হয়, গণবণ্টন ব্যবস্থার খাদ্যপণ্যে যে চুরি হয়, তা একক ভাবে সামান্য— কিন্তু গোটা দেশের জন্য যোগ করলে বিপুল। এই চুরির রাজনৈতিক রঙ বিচার করতে বসলে রামধনু তৈরি হবেই। সব দলই প্রায় সমান ভাবে জড়িত। যত ক্ষণ না হিসেবনিকেশের পদ্ধতি বদলাচ্ছে, সম্পূর্ণ ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রবর্তিত হচ্ছে, তত ক্ষণ এই চুরি ঠেকানোর উপায় নেই। এই দুর্নীতির দায়ও শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের ঘাড়ে চাপানো ঠিক হবে না।
কিছু দিন আগে এক সাক্ষাৎকারে অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন বলেছিলেন, গোটা দেশ জুড়ে দুর্নীতির যে রমরমা চলছে, তার কারণ রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক। যে দলের সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, এই দুর্নীতি ঠেকানোর উপায় নেই। কথাটা ভেবে দেখার মতো। সাম্প্রতিক অতীতে বহু রাজ্যেই জমি কেলেঙ্কারি, খনি মাফিয়া কেলেঙ্কারি, আর্থিক জালিয়াতি, নির্মাণ কেলেঙ্কারি হয়েছে। আবার, বেসরকারি ক্ষেত্রেও যে হয়রানি হয়— হাসপাতালে, বিমা ক্ষেত্রে— সেগুলোকেও কি দুর্নীতির বড় আখ্যান থেকে বাদ রাখতে পারবেন?
কাজেই, দুর্নীতির যে সহজগল্পটি বাজারে চলছে, সেটা মেনে নেওয়ার আগে একটু যাচাই করে নেওয়া ভাল।
কলকাতায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটে অর্থনীতির শিক্ষক