সম্পাদকীয় ২

স্বৈরতন্ত্রে ফিরিবে কি

মায়ানমারের সামরিক জুন্টা তিন বছর আগে যখন তাহার উর্দি খুলিয়া রাখিয়া গণতান্ত্রিক সংস্কারের পথে অগ্রসর হওয়ার সদিচ্ছা প্রদর্শন করে, তখন অনেকেই আশা করিয়াছিলেন, বাঁশের চিকের অন্তরালে পড়িয়া থাকা দেশটি মুক্তির সুবাতাস পাইবে। শঙ্কা হইতেছে, সেই আশা পূরণের পথে কাঁটা পড়িতেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share:

মায়ানমারের সামরিক জুন্টা তিন বছর আগে যখন তাহার উর্দি খুলিয়া রাখিয়া গণতান্ত্রিক সংস্কারের পথে অগ্রসর হওয়ার সদিচ্ছা প্রদর্শন করে, তখন অনেকেই আশা করিয়াছিলেন, বাঁশের চিকের অন্তরালে পড়িয়া থাকা দেশটি মুক্তির সুবাতাস পাইবে। শঙ্কা হইতেছে, সেই আশা পূরণের পথে কাঁটা পড়িতেছে। প্রেসিডেন্ট থাইন সেইন-এর সরকার সামরিক স্বৈরাচারের অন্ধকূপেই ফিরিয়া যাইতে উদ্গ্রীব। ফলে জাতিদাঙ্গাকে কেন্দ্র করিয়া মায়ানমারের রাস্তায় সান্ধ্য আইন জারি হইয়াছে, চলিতেছে সেনা-টহল। মান্দালয়ের বিস্তীর্ণ শহরে বৌদ্ধ জঙ্গিদের হাতে মুসলিম সংখ্যালঘুদের আক্রান্ত, হতাহত হওয়ার যে সব ঘটনা ঘটিতেছে, তাহা দমন করার দোহাই দিয়া নাগরিকদের ক্ষণস্থায়ী স্বাধীনতা ও অধিকারগুলি কাড়িয়া লওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হইয়াছে। দুর্যোগের লক্ষণ।

Advertisement

প্রেসিডেন্ট থাইন সেইন তিন বছর পূর্বে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিয়াছিলেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরাইয়া দিয়াছিলেন, ‘সেন্সরশিপ’ও প্রত্যাহার করিয়াছিলেন। দেশে একটা গণতন্ত্রের আবহাওয়া ছড়াইয়া পড়ে। বাক্স্বাধীনতা ফিরিয়া আসে, আতঙ্ক ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পরিবেশ দূর হয়। এই পরিস্থিতিতেই বিরোধী নেত্রী আং সান সু চি-ও জাতীয় পার্লামেন্টে শামিল হন। তাঁহার এই যোগদান দেশের জঙ্গি শাহিকে এক ধরনের গণতান্ত্রিক বৈধতায় মণ্ডিত করে। এতটাই যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি-সহ অধিকাংশ পশ্চিমী গণতন্ত্রই মায়ানমারের এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানায় এবং ওই সব দেশের বিনিয়োগকারীরা ব্যবসায়িক স্বার্থেই মায়ানমারে উন্নয়নের পরিকাঠামো নির্মাণে লগ্নি শুরু করেন। কিন্তু সামরিক শাসনের কড়াকড়ি শিথিল হইতেই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও জাতিদাঙ্গার সুপ্ত উপাদানগুলি পরিপক্ব হইতে থাকে, বিস্ফোরিতও। প্রথমে রাখিন প্রদেশের রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর হামলা দিয়া শুরু। ক্রমশ মান্দালয়ের মতো বহুজাতিভাষাসংস্কৃতির শহরেও সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ নামিয়া আসে। প্রেসিডেন্ট থাইন সেইন গণতন্ত্র বলিতে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের অগ্রাধিকার বুঝেন, সংখ্যালঘুর অস্তিত্বের সমস্যা ও সঙ্কট তাঁহাকে বিচলিত করে নাই। তাই তাঁহার সরকার আইন পাশ করিয়া ধর্মান্তরকরণ এবং এক সম্প্রদায়ের মহিলাদের অন্য সম্প্রদায়ে বিবাহও নিষিদ্ধ করেন। সেই সঙ্গে অন্য সম্প্রদায়ের হামলা হইতে সংখ্যাগরিষ্ঠদের রক্ষা করার আইন শত শত মুসলিমকেই হত্যার পথ সুগম করিয়া দেয়।

সু চি এত অনাচার দেখিয়াও যে মুখে কুলুপ আঁটেন, তাহার কারণ তিনি নিজে আগামী বছর অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জঙ্গি জেনারেলদের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হইয়া দেশের শাসনভার হাসিল করার খোয়াব দেখেন। কিন্তু ঘটনার বাঁক যে দিকে, তাহাতে তেমন সম্ভাবনা কম। সু চি-র প্রেসিডেন্ট হওয়ার অধিকার কাড়িয়া লইয়া ইতিমধ্যেই তাঁহার ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রাসি-র ভোট বয়কটের সম্ভাবনা বাড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। প্রশ্ন উঠিয়াছে, তবে কি গণতান্ত্রিক সংস্কারের পথ পরিহার করিয়া মায়ানমার সামরিক স্বৈরাচারেই ফিরিয়া যাইতে ইচ্ছুক? বিদেশি লগ্নিকারীরাও আর বিনিয়োগে তত উত্‌সাহ দেখাইতেছেন না। তাঁহাদের কাছে জঙ্গি শাহি প্রতিশ্রুত রাজনৈতিক স্থিতিই যথেষ্ট নয়, সেই সঙ্গে গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদও তাঁহাদের কাছে রক্ষাকবচের মতো। মায়ানমারের বর্তমান নেতৃত্ব দেশকে সেই রক্ষাকবচটি পরাইতে দ্বিধান্বিত। তাই মাঝপথে পথ হারানোর আশঙ্কা।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন