সম্পাদকীয় ২

স্বতঃস্ফূর্ত?

নাগাল্যান্ডে এক জন মুখ্যমন্ত্রী আছেন, একটি নির্বাচিত সরকার আছে, আইন ও সংবিধানের শাসন আছে, বিশ্বাস করা কঠিন। এই সব থাকিলে ডিমাপুরের জেলখানা হইতে এক বন্দিকে বাহির করিয়া আনিয়া কয়েক হাজার উন্মত্ত জনতা প্রকাশ্যে তাঁহাকে গণপ্রহারে নৃশংসভাবে হত্যা করিতে পারিল কেমন করিয়া? কয়েক হাজার লোক সমবেত ভাবে জেলখানায় প্রবেশ করেই বা কী ভাবে?

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৫ ০০:০১
Share:

নাগাল্যান্ডে এক জন মুখ্যমন্ত্রী আছেন, একটি নির্বাচিত সরকার আছে, আইন ও সংবিধানের শাসন আছে, বিশ্বাস করা কঠিন। এই সব থাকিলে ডিমাপুরের জেলখানা হইতে এক বন্দিকে বাহির করিয়া আনিয়া কয়েক হাজার উন্মত্ত জনতা প্রকাশ্যে তাঁহাকে গণপ্রহারে নৃশংসভাবে হত্যা করিতে পারিল কেমন করিয়া? কয়েক হাজার লোক সমবেত ভাবে জেলখানায় প্রবেশ করেই বা কী ভাবে? ইহা কি ফরাসি বিপ্লব, বাস্তিল দুর্গ তথা কারাগারের পতনের স্বতঃস্ফূর্ত গণজোয়ার? ডিমাপুরের পুলিশই বা কী করিতেছিল? এই উপদ্রুত রাজ্যে নিরাপত্তা বন্দোবস্ত তো অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় আরও আঁটোসাঁটো থাকার কথা। কারারক্ষীরাই বা কোথায় ছিলেন? তাঁহারা জনতার দাবি মানিয়া এক জন বিচারাধীন বন্দিকে তাহাদের হাতে তুলিয়া দিলেন কেমন করিয়া? তবে কি এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডে তথাকথিত ‘জনতা’র সহিত পুলিশ ও কারারক্ষীদের যোগসাজশ ঘটিয়াছিল? অস্বস্তিকর এই প্রশ্নগুলির জবাব নাগাল্যান্ডের প্রশাসনকে, নির্বাচিত শাসক গোষ্ঠীকে দিতে হইবে।

Advertisement

নিহত যুবক সৈয়দ ফরিদ খান ডিমাপুরে ছোটখাটো ব্যবসায়ে যুক্ত ছিলেন। নাগা মহিলাকে বিবাহ করিয়া ডিমাপুরেই বসবাস করিতেন, তাঁহাদের একটি কন্যাসন্তানও আছে। আদতে অসমের করিমগঞ্জ জেলার বাসিন্দা ফরিদ এক অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় ফৌজির সন্তান এবং তাঁহার দুই ভাই এখনও ওই ফৌজেই কর্মরত। এমন একজনের বিরুদ্ধে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’র তক্মা লাগাইল কাহারা এবং কেন? এ ধরনের একটি তক্মা লাগাইলে তাহাকে গণপ্রহারে হত্যা করা ‘তত আপত্তিকর’ মনে হইবে না বলিয়া? তাই কি নিহত ফরিদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মতো মারাত্মক অভিযোগ তুলিলেও তাহার সত্যতা যাচাই বা আদালতে তাহার বিচারের জন্য অপেক্ষা করার ধৈর্য গণঘাতকরা ধরিতে পারিল না? উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ‘ভূমিপুত্র’ জনজাতি বনাম ‘বহিরাগত’র পারস্পরিক অনাস্থা, সন্দেহ ও বিদ্বেষ এমন নিষ্ঠুরতায় বিস্ফোরিত হইল! স্বভাবতই এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় সারা অসমে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হইয়াছে। ডিমাপুরেও অ-নাগা জনসাধারণের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার ঘটিয়াছে। অতীতে বড়োল্যান্ড আঞ্চলিক স্বশাসনের এলাকায় রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক হানাহানির ভয়াবহ রূপ দেখা গিয়াছে। আবার সেই সমাচার অবশিষ্ট ভারতে পৌঁছাইলে সেখানে বিভিন্ন শহরে-জনপদে মঙ্গোলয়েড জনজাতির তরুণ-তরুণীদের উপর ক্রোধ নামিয়া আসিয়াছে। তাঁহারা গুয়াহাটি-গামী ট্রেনে চড়িয়া বসিয়াছেন। ভারতের জাতীয় সংহতি এতই ঠুনকো!

আশার কথা, অসম ও নাগাল্যান্ডের মুসলিমদের সংগঠনগুলি অবশিষ্ট দেশের মুসলিমদের কাছে পত্রপাঠ বার্তা দিয়াছেন যে, সম্প্রদায় হিসাবে তাঁহাদের উপর কোনও আক্রমণ ঘটে নাই, তাই মুসলমানরা যেন উত্তেজিত না হন। ডিমাপুরের ঘটনা কেবল রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির চেহারাটাই প্রকট করে না, সমাজে দীর্ঘ কাল যাবৎ পাশাপাশি বসবাস করা বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের সমূহ অভাবকেও স্পষ্ট করিয়া তোলে। মনে হয়, এই অভাব তলে-তলে এমন একটা বারুদস্তূপ সমাজে সঞ্চিত রাখিয়াছে, যাহা কেবল একটি স্ফুলিঙ্গের অপেক্ষায়। প্রশাসন অতঃপর নিশ্চয় নানা কঠোর পদক্ষেপ করিবে। তাহা নিশ্চয়ই জরুরি। কিন্তু তাহাতে বিরোধ ও অনাস্থার বিষ দূর হইবে কি?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement