লোকসভা নির্বাচনে পরাস্ত কংগ্রেস দলের একমাত্র কাজ হইয়া দাঁড়াইয়াছে, ষোড়শ লোকসভায় নরেন্দ্র মোদীর সরকার যে বিলই আনুক, তাহার বিরোধিতা করা। তাহা না হইলে রাতের শিফ্টে মহিলাদের কাজ করা সংক্রান্ত শ্রম আইন সংস্কারের যে প্রস্তাব শ্রম মন্ত্রী আইনসভায় পেশ করিয়াছেন, এই দল আপত্তি করিবে কেন? একদা সংস্কারের প্রবক্তা ও অগ্রদূত কংগ্রেস মহিলাদের রাতের শিফ্টে কাজ করা লইয়া আপত্তি জানাইতে পারে, বিস্ময়ের কথা। বামপন্থীরা বরাবরই এমন সংস্কারের বিপক্ষে। মহিলাদের নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলিয়া তাঁহারা সন্ধ্যা ৭টা হইতে সকাল ৬টা পর্যন্ত মহিলাদের বাহিরের কাজে যাইতে দিতে নারাজ। তাঁহাদের বক্তব্য, যেহেতু বিশেষত শহরাঞ্চলে মহিলারা ওই সময় রকমারি নিগ্রহ-লাঞ্ছনার সম্মুখীন হইয়া থাকেন, তাই রাত-শিফ্ট মহিলাদের জন্য নিষিদ্ধই থাকা উচিত। কংগ্রেসও এখন এই উদ্ভট কুযুক্তির প্রতিধ্বনিতে মুখর!
সত্য, দেশে মহিলাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নানা অপরাধ তাঁহাদের নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে নূতন করিয়া সামনে আনিয়াছে। বেঙ্গালুরুর মতো শহরে তথ্য-প্রযুক্তি শিল্পে রাত-শিফ্টে কর্মরত মহিলাদের কেহ কেহ কখনও কখনও বাড়ি ফিরিবার পথে নিগৃহীতও হইয়াছেন। কিন্তু এই সব ঘটনায় মহিলারা দমিয়া যান নাই, তথ্য-প্রযুক্তি শিল্পে তাঁহাদের কর্মসংস্থানেও কোনও ভাটা পড়ে নাই। অবাঞ্ছিত হইলেও ব্যতিক্রমী ওই সব ঘটনা তাঁহাদের নিরুৎসাহ করে নাই। তথ্য-প্রযুক্তি শিল্পে কর্মরত মহিলাদের রাত্রে বাড়িতে পৌঁছাইবার দিবার বন্দোবস্তটিও আগের তুলনায় উন্নত হইয়াছে। মহিলাদের— শুধু মহিলাদের কেন, সকল নাগরিকেরই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। রাত্রে মহিলাদের বাড়ির বাহির হইতে হইলে দিনের বেলার মতোই তাঁহাদের গতিবিধি অবাধ ও নিরাপদ করার দায় সরকারের, আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষের। এই দিকটির উপর নিশ্চয় সরকারকে নজর দিতে হইবে, কিন্তু নিরাপত্তার অভাবের দোহাই দিয়া রাত-শিফ্টে কাজ করার সুযোগ হইতে মহিলাদের বঞ্চিত করার উদ্যোগ অন্যায়। বস্তুত, তথ্য-প্রযুক্তি শিল্পের অভিজ্ঞতাই দেখাইয়া দেয়, মেয়েরা যত বেশি কাজে যোগ দিবেন, তাঁহাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করিবার চাপও ততই বাড়িবে।
নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলিয়া মেয়েদের কাজের পরিধি সংকোচনের পিছনে সমাজের প্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার ছায়া অতি স্পষ্ট এবং দুর্মর। চিরকালই এই অজুহাতে নানা ভাবে তাঁহাদের পুরুষের পিছনে রাখা হইয়াছে, প্রতিযোগিতার সুযোগ দেওয়া হয় নাই। মহিলাদের ‘মঙ্গলচিন্তা’র নামে এই মানসিকতা তাঁহাদের সুযোগসাম্য হইতে দূরে রাখিতে চায়। বস্তুত, মেয়েরা রাত্রে ঘরে থাকিলে নিরাপদে থাকিবেন, এই যুক্তিতে তাঁহাদের বাহির হইতে না দিয়া তাঁহাদের জন্য যে নিরাপত্তা বরাদ্দ হয়, তাহা কারাগারের নিরাপত্তা। যে সমাজ প্রতিটি নাগরিককে অবাধ প্রত্যয়ে কাজ করিবার স্বাধীনতা ও সুযোগ দিতে পারে, তাহাই একটি যথার্থ আধুনিক সভ্য সমাজ। ২০১৪ সালের ভারত সেই সমাজ নির্মাণের সাধনা করিতে পারিবে না? এখনও সময় হয় নাই? বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতার মোহ এমনই দুর্নিবার? নেতির অন্যায় পথ ছাড়িয়া রাহুল গাঁধীরা বরং কর্মী-মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন স্তরে প্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি করিতে উদ্যোগী হইতে পারেন। কাজের কাজ হইবে।