সম্পাদকীয় ১

সভ্যতা দূর অস্ত্

তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারা বাতিল হইয়াছে। তথ্যপ্রযুক্তি আইন বাতিল হয় নাই। কেন হইবে না? সুপ্রিম কোর্ট সেই প্রশ্ন তোলেন নাই, হয়তো তুলিবার কথাও ছিল না, কারণ আদালত একটি নির্দিষ্ট মামলার প্রসঙ্গেই নির্দিষ্ট রায় দিয়াছে। হয়তো সুপ্রিম কোর্ট মনে করে, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের প্রয়োজন আছে, ৬৬এ ধারা ভিন্ন অন্য ধারাগুলিরও প্রয়োজন আছে। বস্তুত, ৬৬এ বাতিল করিবার যুক্তি হিসাবে অন্য একাধিক ধারার দৃষ্টান্তও সর্বোচ্চ আদালত উল্লেখ করিয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৫ ০০:০০
Share:

তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারা বাতিল হইয়াছে। তথ্যপ্রযুক্তি আইন বাতিল হয় নাই। কেন হইবে না? সুপ্রিম কোর্ট সেই প্রশ্ন তোলেন নাই, হয়তো তুলিবার কথাও ছিল না, কারণ আদালত একটি নির্দিষ্ট মামলার প্রসঙ্গেই নির্দিষ্ট রায় দিয়াছে। হয়তো সুপ্রিম কোর্ট মনে করে, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের প্রয়োজন আছে, ৬৬এ ধারা ভিন্ন অন্য ধারাগুলিরও প্রয়োজন আছে। বস্তুত, ৬৬এ বাতিল করিবার যুক্তি হিসাবে অন্য একাধিক ধারার দৃষ্টান্তও সর্বোচ্চ আদালত উল্লেখ করিয়াছে। আদালতের বিচার এবং সিদ্ধান্তকে অশ্রদ্ধার প্রশ্ন নাই। এই রায়ের ঐতিহাসিক গুরুত্বও অনস্বীকার্য। কিন্তু তাহার পরেও প্রশ্নটি থাকিয়া যায়: তথ্যপ্রযুক্তি আইন কেন? তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করিয়া কেহ যদি কোনও অন্যায় করে, তাহার মোকাবিলা নিশ্চয়ই জরুরি। কিন্তু তাহা তো দেশের সাধারণ আইনি কাঠামোতেই সম্ভব। ময়দানে দাঁড়াইয়া সরাসরি দাঙ্গা লাগাইবার প্ররোচনা দেওয়ার মোকাবিলায় যে আইনি অস্ত্র প্রযুক্ত হয়, সোশ্যাল মিডিয়া মারফত একই প্ররোচনা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাহা প্রয়োগ করা হইবে, ইহা স্বাভাবিক ও সঙ্গত, সে জন্য সাধারণ আইনে পদ্ধতিগত সংশোধন করা চলিতে পারে, কিন্তু স্বতন্ত্র তথ্যপ্রযুক্তি আইনের প্রয়োজন হইবে কেন?

Advertisement

উন্নত দুনিয়ার অভিজ্ঞতাও এই একই প্রশ্ন তোলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানের ‘প্রথম সংশোধনী’তে বাক্স্বাধীনতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব ও মর্যাদা দেওয়া হইয়াছে, সেখানে আইন করিয়া তথ্যপ্রযুক্তি মারফত মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করিবার কোনও পাইকারি ব্যবস্থার প্রশ্নই ওঠে না। ব্রিটেনে আপাতদৃষ্টিতে তথ্যপ্রযুক্তি আইন আছে, কিন্তু তাহার উদ্দেশ্য ও বিধেয় ভারতীয় আইন হইতে স্বতন্ত্র, বস্তুত বিপরীত। সেখানে আইনের প্রধান লক্ষ্য: ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংস্থার নিজস্ব পরিসরকে অপরের, বিশেষত রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ হইতে সুরক্ষিত রাখা। যেমন, ব্যক্তি বা সংস্থার নিজস্ব তথ্য-পরিসংখ্যান সুরক্ষিত রাখিবার অধিকার, কিংবা নিরাপত্তার প্রয়োজনে রাষ্ট্র যে তথ্য জানিতেছে তাহার অপব্যবহার নিবারণের বন্দোবস্ত। ব্রিটিশ ‘তথ্যপ্রযুক্তি আইন’ সম্পর্কে খোঁজ করিতে চাহিলে প্রধানত যে আইনের বিভিন্ন সংস্করণের বিবরণ মিলিবে, তাহার নাম ‘ডেটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট’। সভ্য দুনিয়া নাগরিকদের রক্ষাকবচ দিতে তৎপর, ভারতে নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করিবার তৎপরতা।

ইউপিএ সরকারের তৎকালীন আইনমন্ত্রী অভিযোগ করিয়াছেন, কিছু উচ্চস্তরের রাজনীতিককে বাঁচাইবার জন্যই তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারার জন্ম। নিজের অপরাধ লাঘব করিবার এই প্রচেষ্টা অবশ্যই দৃষ্টিকটু। কিন্তু এ দেশে ক্ষমতাবানদের বাঁচানোর জন্য আইন বানাইবার তৎপরতা সত্যই পরিচিত ব্যাধি। ইন্দিরা গাঁধীর জরুরি অবস্থা তাহার চরম নমুনা, কিন্তু অন্য নমুনাও ভারতীয় নাগরিকরা দেখিয়াছেন। আশির দশকে রাজীব গাঁধীর সরকার সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যে ভয়ানক রকমের অ-গণতান্ত্রিক মানহানি আইন জারি করিয়াছিল, তাহারও লক্ষ্য ছিল ক্ষমতার অধীশ্বরদের সমালোচনার বিরুদ্ধে বিশেষ বর্ম সরবরাহ করা। লক্ষণীয়, ক্ষমতাবানদের বাঁচাইতে নাগরিকের অধিকার হরণের এই দুই কলঙ্কিত উদ্যোগের ধারায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনের উদ্যোগটি যুক্ত হয় কংগ্রেসের জমানাতেই, এবং নেহরু-গাঁধী পরিবারের পৌরোহিত্যেই। বিজেপি ক্ষমতায় আসিয়া অবিলম্বে এই আইনটির, কেবল ৬৬এ ধারা নয়, খোলনলচে বদলাইয়া ফেলিবার সুযোগ পাইয়াছিল। সেই সুযোগ হেলায় হারাইয়া এখন আদালতের মার খাইয়াছে এবং আত্মপক্ষ

Advertisement

সমর্থনের নানা অজুহাত খাড়া করিবার করুণ প্রচেষ্টা চালাইয়া লোক হাসাইতেছে। কংগ্রেস তবু আপন কুকীর্তির মাসুল গনিতেছে, নরেন্দ্র মোদী ও তাঁহার সহকর্মিবৃন্দ অপরের ময়লা সাফ করিতেই নাজেহাল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন