রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়: আরও কিছু
সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে আশিস পাঠক (‘বাঙালির মুক্তির সন্ধান...’ ১২-৪) এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, ‘কূপমণ্ডূকতা থেকে মুক্তির সাধনাতেই তিনি অন্য রকম বাঙালি’। কিন্তু কূপমণ্ডূকতা থেকে মুক্তি ছাড়া তাঁর প্রবাসী বাঙালি চর্চায় অন্য আঙ্গিকও ছিল। তাঁর রচনাসমূহ বিশ্লেষণ করলে তেমনটাই মনে হয়।
প্রথমেই স্পষ্ট হওয়া দরকার যে, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এক জন সম্পাদক হিসেবে ছিলেন বিস্ময়কর ভাবে নিরপেক্ষ। তিনি কেমন রবীন্দ্র-অনুরাগী বা কতটা রামমোহন অনুগামী ছিলেন, তা আমাদের জানা। তবুও প্রবাসীতে তিনি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়-কৃত রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’-র প্রতিকূল সমালোচনা কিংবা ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রামমোহন রায় ও রাজারাম সম্পর্কিত বিতর্কিত বিষয় ছাপাতে দ্বিধাবোধ করেননি।
প্রবাসী বাঙালিদের কৃতির প্রতি বাংলার ও বাংলার বাইরের বাঙালিদের দৃষ্টি আকর্ষণের কাজে জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তাঁর প্রধান সহায় হলেও (এই বক্তব্য স্বয়ং রামানন্দ ‘প্রবাসী’র চল্লিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে লিখেছিলেন), তিনি নিজেও এ সংক্রান্ত বহু প্রবন্ধের ও প্রতিবেদনের লেখক। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, স্বামী অভেদানন্দ–সহ আরও অনেক বিশিষ্ট কিন্তু তৎকালীন সময়ে স্বল্পপরিচিত প্রবাসী বাঙালির জীবনী রচয়িতাও তিনি। সুতরাং এ নিয়ে তাঁর অভিপ্রায় অনুধাবন করতে হলে তাঁর রচনাসমূহও বিচার্য।
তিনি ‘প্রবাসী বাঙ্গালীর নিবাস ও কার্য্য’ শিরোনামে প্রবাসীতে (আশ্বিন ১৩১১) সেনসাস রিপোর্ট-সহ তথ্যপৃথুল একটি প্রবন্ধ লেখেন। সব বাঙালিই যে কূপমণ্ডূকতা দোষে দুষ্ট ছিলেন না সে কথা ব্যক্ত করে তিনি বলেন: ‘বাঙ্গালীরা সকলেই কূপমণ্ডূক এ কথা আমরা বলি না। কিন্তু তাঁহাদের প্রাদেশিক সঙ্কীর্ণতা থাকিলে বেশী দোষ দেওয়া যায় না। আমরা বাঙ্গালীত্ব হইতে ‘ভারতীয়ত্বে’ পৌঁছিবার সুযোগ পাইয়াছি। সমস্ত ভারতবাসী এক না হইলে উন্নতির আশা নাই। উন্নতি কেন, রক্ষা নাই। আমরা ভারতবাসী-জাতি গড়িবার চূণ-সুরকি বা বন্ধনরজ্জু হইতে পারি’।
বাঙালিকে ভারতীয়ত্বের সাধনায় মগ্ন করবার রূপকার হলেও তিনি সচেতন ছিলেন ‘প্রবাসী বাঙ্গালী বিদ্বেষ’ (দ্র: প্রবাসী, বৈশাখ ১৩১১) নিয়ে। তাই কম্বুকণ্ঠে বলতে পেরেছিলেন, ‘বাঙ্গালী যে যে প্রদেশে গিয়াছে, তাহারই হিতসাধন করিয়াছে। এই সকল কারণে প্রবাসী বাঙ্গালীর প্রতি বিদ্বেষ নিতান্ত অসঙ্গত ও অযৌক্তিক বলিয়া বোধ হয়। অবশ্য প্রবাসী বাঙ্গালীদিগেরও দোষ আছে। উভয় পক্ষই নিজ নিজ দোষ পরিহার করিয়া সৌহার্দ্দ্যসূত্রে বদ্ধ হইলে কালে একটি ভারতীয় জাতি গঠিত হইতে পারিবে।’
এই প্রসঙ্গে তাঁর আরও দুটি লেখনীর উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমত, ‘বাঙ্গালীর গ্রহণযোগ্য কি দেখিয়াছি’ (প্রবাসী, শ্রাবণ ১৩১৯) শীর্ষক রচনায় তিনি ঊনত্রিশটি বিষয় চিহ্নিত করে প্রবাসী বাঙালিদের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহে আবেদন জানান। যদিও এর প্রেক্ষিতে খুব বেশি সাড়া তিনি পাননি। দ্বিতীয়ত, ‘প্রবাসী বাঙ্গালীর কথা’ (প্রবাসী, পৌষ ১৩১৪) শীর্ষক নিবেদনে তিনি প্রবাসী বাঙালিদের কর্মসংস্থান সংকোচনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। রামানন্দের প্রয়াণের পর ক্ষিতিমোহন সেন প্রবাসীতে (পৌষ ১৩৫০) তাঁকে নিয়ে একটি প্রয়াণলেখ রচনা করেন: ‘পুণ্যচরিতকথা’। ক্ষিতিমোহন স্বয়ং ছিলেন প্রবাসী বাঙালি (জন্ম কাশীতে, পরে চলে আসেন শান্তিনিকেতনে)। সেই ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা থেকে ওই প্রবন্ধে প্রবাসী বাঙালিয়ানার দুর্গতির কথা তিনি তুলে ধরেন: ‘তাঁহারা প্রবাসী বাঙালিরা সাহিত্যের ধার ধারেন না, তাই বাংলা ভাষার চর্চাও কোথাও নাই। বাঙালির ছেলেরা উর্দু বা হিন্দি শিখিয়া পরীক্ষা পাশ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা অচল। এই জন্য কাহারও মনে কোনো খেদ নাই। এই ছিল কাশীর অবস্থা। বাংলার বাহিরে সর্বত্রই ছিল এই দুর্গতি।’ এখানেই অনুভূত হবে রামানন্দ-কর্মের মহিমা।
প্রবাসীতে (বিবিধ প্রসঙ্গে) বছর বছর ঘটা করে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের ছবি ও খবর বেরোত। এ নিয়ে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সচিত্র দীর্ঘ একটি প্রবন্ধও লেখেন। ‘গোরখপুরে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’ (প্রবাসী, ফাল্গুন ১৩৪০)। রামানন্দের বাঙালিয়ানা যে কোনও প্রাদেশিক সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট ছিল না, সে প্রমাণ উপরিউক্ত রচনায় আমরা পেয়েছি। তিনি মনে করতেন: ‘যাহাদের ভাষা এক, তাহারা যেখানেই থাকুক তাহাদের পরস্পরের সহিত যোগ রক্ষা করা আবশ্যক।... এই জন্য বাঙালিদের ঐক্য খুব বেশি হওয়া দরকার। বলা বাহুল্য এই ঐক্যের উদ্দেশ্য অন্য কাহারও অনিষ্টসাধন নহে—ইহা কেবলমাত্র আপনাদের কল্যাণসাধন এবং অপর সকলেরও কল্যাণসাধনের নিমিত্ত আবশ্যক।’ (দ্র: শেষোক্ত প্রবন্ধ)।
তাই বাংলার বাঙালিকে কূপমণ্ডূকতা থেকে মুক্তি দানের খ্যাতিবিহীন কর্মে এবং প্রবাসী বাঙালিকে বাংলার সংস্কৃতি ও কৃষ্টির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার নিরলস সাধনায় আজীবন রত থেকে তিনি এক অলোকসামান্য বাঙালি। এবং বর্তমান বিশ্ব বাঙালি সমাজের কাছে এক প্রাসঙ্গিক ব্যক্তিত্ব।
অর্ণব নাগ। কলকাতা-১৫৭
জাবালি
‘ধর্মের নামে চরম অধর্ম’ (৪-৩) লেখাটিতে ইমানুল হক প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন, ‘রামদের গুরুদেব জাবালি ছিলেন নাস্তিক’ হক মহাশয়ের কথা দুটি ঠিক নয়। ‘রামদের’ তথা রাজা দশরথের সময় ইক্ষাকু রাজবংশের কুলগুরু ছিলেন বশিষ্ঠ।
জাবালি নাস্তিক ছিলেন সে কথাও বলা যায় না। চিত্রকূট পর্বতে রামের সঙ্গে দেখা করে ভরত অনেক কাকুতিমিনতি করেও রামকে পিতৃসত্য রক্ষার প্রতিজ্ঞাপালনের সিদ্ধান্ত থেকে নিবৃত্ত করতে পারেননি। সে সময় জাবালি বাস্তববাদী যুক্তিজাল বিস্তার করে রামকে বলেছিল, পিতৃসত্য রক্ষার দায় তার নয়, তার উচিত কাজ হবে ভরতের অনুরোধ অগ্রাহ্য না-করে অযোধ্যায় ফিরে গিয়ে রাজ্যভার গ্রহণ করা। জাবালির যুক্তি শুনে রাম তাকে ‘বেদবিরোধী নাস্তিক’ বলে তিরস্কার করলে জাবালি সঙ্গে সঙ্গে সুর পাল্টে রামকে সবিনয় বলেছিল, ‘আমি নাস্তিকের বাক্য বলছি না। আমি নাস্তিক নই, পরলোকাদি কিছু নেই, এমনও নয়। আমি সময় বুঝে আস্তিক বা নাস্তিক হই।...’ (বাল্মীকি রামায়ণ, ১০৯/৩৮-৩৯)।
বিমলেন্দু ঘোষ। কলকাতা-৬০