রবীন্দ্র সরোবরের পরিকল্পিত সর্বনাশ
রবীন্দ্র সরোবর নিয়ে (১৫-১১) প্রতিবেদনের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু যাঁদের দেওয়া তথ্যকে ভিত্তি করে প্রতিবেদন লেখা হয়েছে তাঁদের বক্তব্যে অনেক অসঙ্গতি আছে। কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারা গঠিত রবীন্দ্র সরোবর রক্ষাণাবেক্ষণের কমিটিতে আমাদের রাখা হয়েছে। রবীন্দ্র সরোবরের ভাল-মন্দের সঙ্গে আমরা বহু বছর ধরে জড়িয়ে আছি।
গত ৬ অগস্ট ২০১৪ কলকাতা হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতিদের নির্দেশের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, রবীন্দ্র সরোবরের জল যেন কোনও রকমেই দূষিত না-হয়। কোনও বর্জ্য পদার্থ, কোনও রকম স্নান, কোনও প্রকার ধোয়া-মোছা— সব কিছু নিষিদ্ধ। কারণ, এই সরোবর বদ্ধ জলাধার। ৬ অগস্ট ২০১৪ মাননীয় হাইকোর্টের নির্দেশের উপর ভিত্তি করে ১৫ অক্টোবর ২০১৪ কেআইটি-র সিইও, যিনি এই রক্ষণাবেক্ষণ কমিটিরও চেয়ারম্যান, একটি মিটিং ডাকেন। তাতে কমিটির সদস্য হিসেবে আমরা (তিন জনের মধ্যে দু’জন ছিলাম, কারণ, এক জন অসুস্থ ছিলেন) ছাড়াও কেআইটি-র সিইও (চেয়ারম্যান), লেক থানার ওসি-র প্রতিনিধি, এবং দু’জন স্থানীয় কাউন্সিলর যোগ দেন। বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে মূল আলোচ্য ছিল রবীন্দ্র সরোবরে প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করা ও জলকে দূষণের হাত থেকে বাঁচানো। কারণ, ২৯/৩০ অক্টোবর ছিল ছট পুজোর উৎসব এবং প্রতি বছর এই উৎসবের পর রবীন্দ্র সরোবরের জল যে ভাবে দূষিত হয় তা অবর্ণনীয়। আমাদের প্রস্তাব ছিল এই ছট পরব রবীন্দ্র সরোবরের বাগানে এবং বদ্ধ জলে না-করে পুণ্যার্থীদের গঙ্গায় পুজো করতে পাঠানো। কিন্তু কেআইটি-র সিইও এবং আরও দু’জন কাউন্সিলর আমাদের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। এবং ২৯/৩০ দু’দিন ধরে পুলিশের চোখের সামনে রাজনৈতিক নেতাদের তত্ত্বাবধানে রবীন্দ্র সরোবরের বাগান ও জল যে ভাবে দূষিত হল তা বলার ভাষা নেই।
দ্বিতীয় বিষয় প্লাস্টিক নিয়ে যখন আলোচনা শুরু হল, আমরা প্রস্তাব দিলাম যে, সরোবরকে প্লাস্টিক মুক্ত করতে হলে রবীন্দ্র সরোবরে হকারদের প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ না-করলে প্লাস্টিক দূষণ আটকানো যাবে না। এ প্রস্তাব শোনামাত্র দু’জন মাননীয় কাউন্সিলর প্রবল আপত্তি জানালেন এবং বললেন, কোনও ভাবে হকারদের ব্যবসা বন্ধ করা যাবে না। আমরা বললাম, হাইকোর্টের নির্দেশ আছে, কে কার কথা শোনে।
আবার, কেআইটি যখন রবীন্দ্র সরোবরের সবুজের মধ্যে সিমেন্ট ঢালতে শুরু করলেন ক্লাব মেম্বারদের গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য, আমরা বাধ্য হয়ে আইনের আশ্রয় নিই। আর মহামান্য হাইকোর্টও আমাদের আবেদনের সঙ্গে সহমত হন। কিন্তু যথারীতি সবুজ ধ্বংস হল।
এই মন্ত্রী নেতাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রবীন্দ্র সরোবর ক্রমশ দূষণের আখড়া হয়ে উঠছে। মুক্ত মঞ্চ ‘নজরুল মঞ্চ’ এখন পরিপূর্ণ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত অডিটোরিয়াম হয়ে গেছে। অজস্র এসি এবং ভারী ভারী জেনারেটরের গ্যাস কী ভাবে রবীন্দ্র সরোবরের বাতাসকে দূষিত করছে, বলে বোঝাতে পারব না। এর সঙ্গে তাল মিলিয়েছে ক্লাবগুলো। তাদের বেআইনি নির্মাণ এবং অফুরন্ত এসি আর জেনারেটরের গ্যাস (একটা ক্লাবে ভোর থেকে হেভি ডিউটি জেনারেটর চলে) আর রাত হলেই গানবাজনার বিকট আওয়াজ, রাতের পাখিদের গৃহছাড়া করছে।
রবীন্দ্র সরোবর অন্যান্য পার্কের মতো নয়। এর চরিত্র আলাদা। এর বায়োডাইর্ভাসিটি অনেকটা বটানিকাল গার্ডেনের সঙ্গে তুলনীয়। তাই ব্যবসায়িক মন নিয়ে তার রক্ষণাবেক্ষণ হবে না। প্রকৃতিকে ভালবাসতে হবে। বুঝতে হবে। সে ক্ষমতা অন্তত এখনকার আমলা বা জননেতাদের নেই। এই পরিবেশ-বন্ধু রবীন্দ্র সরোবর, যা জাতীয় উদ্যানের সম্মানে সম্মানিত এবং যা প্রতিদিন হাজার হাজার আবালবৃদ্ধবনিতাকে শুদ্ধ প্রকৃতির আনন্দ দেয়, তাঁরা কোমর বেঁধে তার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করতে উঠে-পড়ে লেগেছেন। না-হলে কর্তৃপক্ষ গত ১৫ তারিখে ভোরবেলায় একটা শুটিংয়ের অনুমতি দিয়ে সকাল বেলাতে রবীন্দ্র সরোবরে সমস্ত শান্তি ভঙ্গ করাতেন না। যে রকম ভাবে ইচ্ছা রবীন্দ্র সরোবরের ভিতরে গাড়ি ছুটল, মাইক বাজানো হল, হকারদের দোকান হল এবং পরিবেশকে গলা টিপে মারা হল। গত ১৭ নভেম্বর চলচ্চিত্র উৎসবের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র সরোবরের ভিতরে অজস্র গাড়ি পার্ক করা হল। এ সবই মহামান্য কলকাতা হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধাচারণ।
মহামান্য হাইকোর্ট নিযুক্ত এই কমিটিতে আমরা যারা পরিবেশ-বন্ধু তারা নিতান্ত অসহায়। কারণ, উদ্যান কমিটির চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে জনদরদি স্থানীয় কাউন্সিলররা (যাঁরা ভোট ছাড়া কিছু বোঝেন না) এবং (অসহায় পুতুলের মতো) পুলিশরা দলে ভারী।
তুষার তালুকদার। প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার কলকাতা, সুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়।
প্রতিবেদকের উত্তর: প্রতিবেদনে বলা হয়েছে রবীন্দ্র সরোবরে জঞ্জাল ভরছে। সেই কারণেই হাইকোর্টের নির্দেশে একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছে। এই কমিটির কাজ রবীন্দ্র সরোবর দেখভাল করা যাতে রবীন্দ্র সরোবর পরিষ্কার থাকে এবং জঞ্জালমুক্ত হয়। এই তথ্যের মধ্যে অসঙ্গতি কোথায়? যোগাযোগ করা হয় কেআইটি কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় কাউন্সিলর চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও। তাঁদের বক্তব্যও উল্লেখ করা হয়। তাঁরা দু’জনেই এই কমিটির মূল লক্ষ্যের ওপর জোর দেন। রবীন্দ্র সরোবর জঞ্জালমুক্ত করা যাচ্ছে না কেন? সেই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দফতরকে জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁরা জানান তাঁদের পরিকাঠামোগত কিছু ত্রুটি রয়েই গিয়েছে। সেগুলিও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা রয়েছে। সুতরাং কমিটি করেও যে দূষণ কার্যত আটকানো যাচ্ছে না তা বলাই বাহুল্য। এখানেও কোনও অসঙ্গতি নেই। প্রতিবেদনের সঙ্গে জঞ্জাল জমে থাকার ছবিও ছাপা হয়েছে। রবীন্দ্র সরোবরকে জঞ্জালমুক্ত করে তার সর্বিক উন্নতি মূল লক্ষ্য। এই বিষয়ে কমিটির সমস্ত সদস্যই একমত হবেন। কমিটির সদস্যদের মধ্যে বাদানুবাদ প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু নয়।
প্রতিবেশী সমাচার
‘সহযাত্রীর উপহার’ (২৪-১১) প্রাপ্ত হইয়া যারপরনাই পুলকিত হইলাম। ইত্যবসরে প্রতিবেশীর গুণাবলি সম্পর্কে সর্বজনবিদিত কিছু তথ্য সম্পর্কে আলোকপাত করা যাইতে পারে। অভিধানে পড়শি বা নিকট বসবাসকারীকে প্রতিবাসীও বলা হইয়াছে। মার্জনা ভিক্ষা চাহিতেছি, কিন্তু যেহেতু আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের এলাকায় সন্নিকট অবস্থানকারী, অতএব অভিজ্ঞতালব্ধ ত্রুটিগুলি সম্পর্কে যৎসামান্য ওয়াকিবহাল থাকিবার একটা সুযোগ থাকিয়া যাইতেছে। বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ:
ক) পাহাড়প্রমাণ কৌতূহল: নিজেদের থোড় বড়ি খাড়া ম্যাড়মেড়ে জীবনকে বিন্দুমাত্র সুস্থ চর্চায় উন্নীত করার প্রয়াস নাই। অথচ, কী কারণে ‘ক’ বাবু অফিস ফেরত নিত্য বিলম্ব করেন, রবিবারেও কেন তাঁহাকে বাহিরে যাইতে হয়, স্বামী স্ত্রী বা গৃহস্থ সদস্যবৃন্দ এত চুপচাপ থাকেন কেন, স্বল্প সংখ্যা বিশিষ্ট পরিবারে নিত্য বাজারের কী প্রয়োজন— ইত্যাদি প্রশ্নাবলিতে তিনি বা তাঁহারা জর্জরিত।
খ) দেওয়ালেরও কান আছে: এই রকমই একটি গান গাহিয়াছিলেন এক শিল্পী। ‘দেনা পাওনা’ গল্পে রামসুন্দর যখন নিরুপমার বিষম আপত্তিতে টাকা না-দিয়াই চলিয়া যাইতে বাধ্য হইয়াছিলেন, সে কথা ‘কোনও স্বভাবকৌতূহলী দ্বারলগ্নকর্ণ দাসী’ শুনিয়া ফেলিয়াছিল।... নিজগৃহে ঘটমান বা ঘটিত অহরহ ঘটনাবলিও তেমনই নিত্য ঔৎসুক্যবাহিত হইয়া পড়শিজনের আনন্দের কারণ হইতেছে। তাহা অপরাপর প্রতিবেশীদের সহিত বৈকালিক দ্বিপ্রাহরিক বা সান্ধ্য অবসর বিনোদনের অপরিহার্য বিষয়।
গ) নিত্য দোষারোপ: ‘ক’ বাবু আড্ডাবাজ নহেন, কেন অলস গুলতানিতে তাঁহাকে পাওয়া যায় না, তাসের উদ্দাম উদ্দীপনায় কেন তিনি উৎসাহী হন না— অতএব, ‘ক’ বাবু দাম্ভিক গোছের, এবং অচিরেই আঁতেল উপাধি প্রাপ্ত হইবেন।
ঘ) দূরত্ব: ‘ক’ বাবুর সহিত প্রতিবেশীদের অবধারিত দূরত্ব রচিত হইবে। তাঁহার বৈদগ্ধ্য বা হেঁ হেঁ পার্টি না-হইবার কারণেও তিনি আপামর এলাকাবাসীর সংখ্যা গরিষ্ঠের নিকট অচিরেই অচ্ছুত হইবেন।
ধ্রুবজ্যোতি বাগচী। কলকাতা-১২৫