প্রবন্ধ ১

হাজার চুরাশির রাজ্যে এখন চুরাশি হাজার

শিল্পের জন্য কোনও মতেই কৃষকের জমি জোর করে নেওয়া যাবে না, এই নীতির আমি অন্ধ সমর্থক। এর জন্য মিছিলে হাঁটতে রাজি আছি, কিন্তু বিনিয়োগের প্রবল স্রোতে এই নীতি ভেসে বেরিয়ে যাবে না তো? যদি যায়, তার পরিণাম কী হবে?একটি টেলিভিশন চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র মহাশয় জানিয়েছেন যে, পশ্চিমবঙ্গে এখন ৮৪ হাজার কোটি টাকার শিল্প-প্রকল্প, রূপায়ণের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে। জানুয়ারি মাসে গ্লোবাল বিজনেস সামিট-এর পরে সরকারি ভাবে জানানো হয় যে, ২ লক্ষ ৪৩ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব এসেছে।

Advertisement

অর্ধেন্দু সেন

শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৫ ০০:০১
Share:

জমা ও খরচ। বিধানসভায় রাজ্য বাজেট পড়ছেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। ছবি: পিটিআই।

একটি টেলিভিশন চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র মহাশয় জানিয়েছেন যে, পশ্চিমবঙ্গে এখন ৮৪ হাজার কোটি টাকার শিল্প-প্রকল্প, রূপায়ণের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে। জানুয়ারি মাসে গ্লোবাল বিজনেস সামিট-এর পরে সরকারি ভাবে জানানো হয় যে, ২ লক্ষ ৪৩ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব এসেছে। ধরে নেওয়া যায়, সেগুলি অন্যান্য প্রকল্পের, সবে প্রস্তাব এসেছে, রূপায়ণের কাজ এখনও শুরু হয়নি। দুইয়ে মিলিয়ে বলতে হয়, শিল্পপতিদের ‘ঘর বাপসি’! ষাটের দশকেও পশ্চিমবঙ্গ ছিল শিল্পের দিক থেকে প্রথম। পরে আমরা দেখলাম, কমিউনিস্টদের উত্থান এবং পুঁজিপতিদের রাজ্য ছেড়ে গমন। অনেক দিনের চেষ্টায় তাঁরা কি এ বার ফিরে এলেন? এ অসম্ভব সম্ভব হল কী করে?

Advertisement

অন্য দিকে কেন্দ্রীয় বাজেটে অরুণ জেটলি সাহেব ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করলেন পশ্চিমবঙ্গের জন্য একটি বিশেষ প্যাকেজে। এই টাকা কী কী কাজে লাগবে, তা ঠিক করবে নীতি আয়োগ। শোনা গেল, এই ধরনের একটি ফান্ড অন্ধ্রপ্রদেশকে দেওয়া হয়েছে শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াবার জন্য। আমরা হতাশ। যে রাজ্যে বিনিয়োগ আপনিই গড়িয়ে আসছে, সেখানে এই সহায়তা মানে তো পয়সা নষ্ট। তার চেয়ে রাজ্যকে টাকাটা নগদ দিলে ভাল হয়, কিন্তু নীতি আয়োগকে সেই কথা বোঝানো যাবে তো?

বাংলায় শিল্পের এই অগ্রগতির কথা কিন্তু অনেকেই মানতে পারলেন না। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত বললেন যে, রাজ্য সরকারের উচিত এই প্রকল্পগুলির তালিকা প্রকাশ করা। সত্যিই ইন্টারনেটে খুঁজে দেখলাম, সরকারের বা কোনও বণিকসভার তৈরি কোনও লিস্ট দেখা গেল না। টুকরো কিছু খবর পড়ে মনে হল, জিন্দালদের শালবনি স্টিল প্লান্ট এই লিস্টে থেকে থাকবে। এই প্রকল্পের রূপায়ণের আশা কিন্তু কম। জিন্দালরা ঘোষণা করেছেন, তিনশো একর কেনা জমি বিনামূল্যে ফিরিয়ে দেবেন। এই প্রকল্পটি বাদ পড়লে এক ধাক্কায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা বাদ পড়ে যায়। এ ছাড়া, ২ হাজার কোটি টাকার কুলপি বন্দর প্রকল্পও হয়তো এই তালিকাভুক্ত। এই বন্দরের কথা প্রথম শুনেছি ১৯৯৫ সালে। কবে তৈরি হবে কেউ জানে না। আসানসোল-দুর্গাপুর অঞ্চলে একটি সারের কারখানা হওয়ার কথা। কয়লাখনিতে যে প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া যায়, সার তৈরি হবে সেই ‘কোল বেড মিথেন’ থেকে। সেই গ্যাস কবে যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যাবে, সেটা কারও পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। এই প্রকল্পে প্রস্তাবিত বিনিয়োগ ৫,৫০০ কোটি টাকা। সিঙ্গুরের জমি টাটা কোম্পানি এখনও ফেরত দেয়নি। তাদের ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ধরাও যায়, আবার না-ও ধরা যায়। তবে আদর্শগত কারণে হয়তো এই প্রকল্প তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। শেষ পর্যন্ত কতগুলি প্রকল্প দাঁড়াবে? মোট কত টাকার বিনিয়োগ হবে? সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আমাদের দেখতে হবে অতীতে কী হয়েছে।

Advertisement

সরকারি ভাবে কোনও বছরের বিনিয়োগ বলতে বোঝায় সেই বছরে চালু করা প্রকল্পগুলিতে বিনিয়োগের পরিমাণ। কেন্দ্রীয় সরকারের শিল্প দফতরের ওয়েবসাইটে এই তথ্য পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গে ২০১০-১১ সালে শিল্পে বিনিয়োগ হয় মাত্র ৩০০ কোটি টাকা। সরকার বদলের ফলে একটা অসুবিধা হয়তো হয়েছিল, তার পরের বছর থেকেই অবস্থার উন্নতি হয়। ২০১২-১৩ সালে এই অঙ্ক বেড়ে হয় ২,৫০০ কোটি। এই সালেই কর্নাটকে বিনিয়োগ হয়েছিল ৫ হাজার কোটি, গুজরাতে ১৫ হাজার কোটি এবং মহারাষ্ট্রে ৩০ হাজার কোটি। সংখ্যাগুলি নির্ভুল মনে করার কোনও কারণ নেই, তবে মোটামুটি ঠিকই। ২০১৩-১৪ আর ২০১৪-১৫ সালের পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। ধরে নিলাম যে, আমাদের রাজ্যে বিনিয়োগ বেড়ে হয়েছে বছরে ৫ হাজার কোটি। তা হলেও তো ৮৪ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আসতে সতেরো বছর পার হয়ে যাবে। কিন্তু যে প্রকল্প নির্মাণে সতেরো বছর লাগবে, সে তো আর লাভজনক থাকবে না। তাই বলা যায় যে, এই বৃহৎ তালিকা থেকে ১৫-২০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হয়তো ঠিকমত রূপায়িত হবে, শিল্পমন্ত্রী নিশ্চয় জানেন। মনে হয় তিনি কোনও লগ্নিকারীকে হতাশ করতে চান না, বা ছোট করে দেখতে চান না। সবাইকে নিয়েই চলতে চান।

এক কালে আমাদের রাজ্যে কলকারখানা হলে তার যন্ত্রপাতি তৈরি হত বেলিলিয়াস রোডে বা তারাতলায়। আজকের অত্যাধুনিক শিল্পে তা হওয়ার জো নেই। যন্ত্রপাতি এখন আসে নানা রাজ্য থেকে, এখন আমাদের জোগান দিতে হয় জমি। শিল্পে কতটা জমি লাগে? শিল্প যত আধুনিক হবে, তাতে জমি ততই কম লাগবে, আবার একসঙ্গে বেশি টাকার লগ্নি হলেও জমি কম লাগবে। কিন্তু কত টাকার বিনিয়োগে কত জমি লাগবে, তা বলা কঠিন। সিঙ্গুরে টাটাদের ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে জমি লেগেছিল ১ হাজার একর। শালবনির স্টিল প্লান্টে ৩৫ হাজার কোটি টাকার জন্য লাগত ৫ হাজার একর। যদি ধরি ১ হাজার একরে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হতে পারে, তা হলে ৮৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে লাগবে ১৭ হাজার একর। ডব্লুবিআইডিসি শিল্প স্থাপনের জন্য খড়্গপুর, রঘুনাথপুর, অন্ডাল, গোদাপিয়াশাল, নৈহাটি ইত্যাদি অঞ্চলে অনেকগুলি ‘পার্ক’ তৈরি করেছে। সব মিলিয়ে এই পার্কগুলিতে ৬ হাজার একর মতো জমি আছে। এই জমি ৮৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের পক্ষে একেবারেই অপ্রতুল। তার মানে, লগ্নিকারী সংস্থাকেই জমির ব্যবস্থা করে নিতে হয়েছে বা হবে। হাওড়ার ফাউন্ড্রি অ্যাসোসিয়েশন আর কলকাতার রাবার শিল্প এই ভাবেই নিজেরাই জমি কিনে ইউনিট বসাচ্ছে। এই প্রক্রিয়া কিন্তু সহজসাধ্য আর নির্বিঘ্ন হয়নি।

শিল্পে ৩ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ হলে, সেই সঙ্গে আবাসন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতালের জন্যও জমি লাগবে। হয়তো প্রয়োজন হবে ১ লক্ষ একর জমির। আমাদের রাজ্যের হিসেবে ১ লক্ষ চাষিকে জমি ছাড়তে হবে। শিল্পের জন্য কোনও মতেই কৃষকের জমি জোর করে নেওয়া যাবে না রাজ্য সরকারের এই নীতির আমি অন্ধ সমর্থক। প্রধানমন্ত্রী বলবেন, এই নীতি থাকলে শিল্প হয় না, উন্নয়ন হয় না, সভ্যতার বিকাশ থমকে যায়, তবুও আমি সমর্থক। এর জন্য মিছিলে হাঁটতে রাজি আছি, কিন্তু বিনিয়োগের প্রবল স্রোতে এই নীতি ভেসে বেরিয়ে যাবে না তো? যদি যায়, তার পরিণাম কী হবে? হাজার চুরাশি-র মা থাকলে তাঁকেই প্রশ্ন করা যেত। তিনি হয়তো এই বিষয়ে অনেক কথা বলতে চাইতেন।

ভূতপূর্ব মুখ্যসচিব, পশ্চিমবঙ্গ সরকার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন