চলছে রেল এবং জাতীয় সড়ক অবরোধ।
স্কুলে লুঠপাটে বাধা দেওয়ায় ৭৪ বছরের বৃদ্ধা সিস্টার ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠল। শুক্রবার গভীর রাতে ঘটনাটি ঘটেছে রানাঘাটের একটি খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে। এই ঘটনার পরে উত্তাল হয়ে ওঠে রানাঘাট। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে স্থানীয় বাসিন্দারা শনিবার দিনভর ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ও রেল অবরোধ করেন। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরে তত্পরতা শুরু হয়। এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আপাতত ধর্ষিতা সিস্টারের অবস্থা স্থিতিশীল বলে চিকিত্সকেরা জানিয়েছেন।
পুলিশ সূত্রের খবর, শুক্রবার গভীর রাতে রানাঘাটের গাংনাপুর থানার ডন বস্কো পাড়ার ওই কনভেন্ট স্কুলটিতে হানা দেয় জনা বারোর এক দুষ্কৃতী দল। স্কুলচত্বরে ঢোকে আট জন। তাদের প্রত্যেকেরই মুখ কাপড়ে ঢাকা ছিল। স্কুল ক্যাম্পাসটি দু’টি বিল্ডিং নিয়ে। একটি বিল্ডিংয়ে পঠনপাঠন চলে। অন্যটিতে থাকেন জনা কয়েক আবাসিক সিস্টার। ওই দিন রাতেও সেখানে ছিলেন তিন জন সিস্টার। অভিযোগ, দুষ্কৃতীরা প্রথমে স্কুলের নিরাপত্তারক্ষীকে মারধর করে তাঁর হাত, পা ও মুখ দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। এর পর স্কুলের অফিসে লুঠপাট চালায় তারা। প্রায় ১২ লক্ষ টাকা, ল্যাপটপ, ক্যামেরা-সহ বেশ কিছু কাগজপত্রও লুঠ হয়েছে বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। রান্নাঘরের দরজা ভেঙে সিস্টারদের আবাসনে ঢোকে দুষ্কৃতীরা।
ওই আবাসনের দোতলায় তিনটি আলাদা ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন সিস্টারেরা। দুষ্কৃতীরা দোতলায় আসতেই তাঁদের ঘুম ভেঙে যায়। বাধা দিতে গেলে তাঁদের আটকে রেখে মারধর চালায় দুষ্কৃতীরা। লুঠপাটে বাধা দেওয়ায় নিজের ঘরেই ৭৪ বছরের এক সিস্টারকে ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ।
লুঠপাট এবং ধর্ষণের পরে বিল্ডিংয়ের দরজা বাইরে থেকে আটকে পালায় দুষ্কৃতীরা। ইতিমধ্যে দড়ি খুলে ফেলেন স্কুলের নৈশরক্ষী। আতঙ্কে এবং মারধরের ফলে ওই রাতে অভিযোগ জানাতে না পারলেও, ভোরের আলো ফুটতেই সাহায্যের জন্য ডাকাডাকি শুরু করেন এক সিস্টার এবং ওই রক্ষী। স্কুলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সিস্টারদের উপর হামলার কথা জানতে পারেন এক পথচারী। তিনিই এলাকার মানুষকে বিষয়টি জানান। এর পর বাসিন্দারাই সিস্টারদের উদ্ধার করেন। ঘটনাস্থলে আসে গাংনাপুর থানার পুলিশ। ধর্ষিতা ওই সিস্টারকে উদ্ধার করে রানাঘাট মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতাল সুপার অতীন্দ্র মণ্ডল বলেন, “ওই মহিলার অবস্থা স্থিতিশীল। বেশ কিছু পরীক্ষাও করানো হয়েছে। তাঁর চিকিত্সার জন্য একটি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে।”
বিক্ষোভে সামিল পড়ুয়ারাও।
ঘটনার কথা জানাজানি হতেই প্রবল উত্তেজনা দেখা দেয় এলাকায়। স্কুলের অভিভাবকদের পাশাপাশি স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন বহু মানুষ। তাঁদের বিক্ষোভে সামিল হন খ্রিস্টান সম্প্রদায়েরও বহু মানুষ। ঘটনার প্রতিবাদে, দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার এবং এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপত্তার দাবিতে শুরু হয় স্কুল লাগোয়া ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক এবং রানাঘাট স্টেশনে রেল অবরোধ। বন্ধ হয়ে যায় ট্রেন ও যানবাহন চলাচল।
স্কুল সূত্রে খবর, দিন সাতেক আগে আচমকা স্কুলে ঢুকে পড়ে জনা পাঁচেক দুষ্কৃতী। টাকা চেয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষকে শাসায় তারা। বাসিন্দাদের অভিযোগ, স্কুল কর্তৃপক্ষ গোটা বিষয়টি জানিয়ে পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করলেও পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। তাঁদের আরও অভিযোগ, সে দিন পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা নিলে এ দিনের ঘটনা এড়ানো যেত।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটনার তীব্র নিন্দা করে সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “দোষীদের বিরুদ্ধে শীঘ্রই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পেয়েই নড়েচড়ে বসেন রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা। ঘটনাস্থলে পৌঁছন জেলাশাসক পি বি সারিন, জেলা পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ। তদন্তভার নিয়েই ঘটনাস্থলে যান সিআইডি-র এডিজি রাজীব কুমার, মুর্শিদাবাদ রেঞ্জের কল্লোল গণাই, এবং সিআইডির এডিজি সিভি মুরলীধরন। রাজীব কুমার বলেন, “তদন্ত শুরু হয়েছে। অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি চালানো হচ্ছে।” ঘটনাস্থল ঘুরে দেখার পাশাপাশি স্কুলের অধ্যক্ষার সঙ্গেও কথা বলেন পুলিশকর্তারা।
বিকেল ৪টে নাগাদ জেলাশাসক এবং অন্য আধিকারিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন অবরোধকারীরা। নিরাপত্তা এবং দুষ্কৃতীদের গ্রেফতারের আশ্বাস দিলে সাড়ে ৪টে নাগাদ অবরোধ উঠে যায়।
যদিও রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ধর্মের ভিত্তিতে সমাজকে বিভাজনের চক্রান্ত চলছে। এটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নয়। কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এমনটা চলছে। ধর্মকে সামনে রেখে যারা এই কাণ্ড করেছে তারা দুষ্কৃতী। যারা এই দুষ্কৃতীদের পিছনে রয়েছে তাদেরকেও খুঁজে বের করতে হবে।” পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, “এটা মানবিকতার উপরে অত্যাচার। ‘রিলিজিয়াস ফ্যানাটিজম’ গোটা দেশ জুড়েই চলছে। কিছু শক্তি সাম্প্রদায়িকতার উসকানি দিচ্ছে। এর পিছনে কারা রয়েছে খুঁজে বের করতে হবে। আমরা ওই সিস্টারের সঙ্গে রয়েছি। মুখ্যমন্ত্রী সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।”
বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “রাত ১২টা থেকে ভোর ৪টে পর্যন্ত ওই কনভেন্টে দুষ্কৃতীরা অত্যাচার চালিয়েছে। ওখানে সিসিটিভি থাকা সত্ত্বেও এটা ঘটেছে। অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার করতে হবে।”
ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য এবং বিতান ভট্টাচার্য।