পাড়ুইয়ের সাগর ঘোষ হত্যা মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ খারিজ করে দিল কলকাতা হাইকোর্ট। বুধবার বিচারপতি জয়ন্ত বিশ্বাস এবং বিচারপতি ঈশানচন্দ্র দাসের ডিভিশন বেঞ্চ এই রায় দেয়। নির্দেশে জানিয়ে দেওয়া হয়, হাইকোর্টের নজরদারিতে বিশেষ তদন্তকারী দলই (সিট) পাড়ুই মামলায় তদন্তের কাজ চালাবে। সাগরবাবুর ছেলে হৃদয় ঘোষের আইনজীবী শীর্ষেন্দু সিংহ রায় জানিয়েছেন, এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যাবেন তাঁরা।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর সাগর ঘোষ হত্যা মামলার তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্টের বিচারপতি হরিশ টন্ডন। কিন্তু, এ দিন ডিভিশন বেঞ্চ বিচারপতি টন্ডনের রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, পাড়ুই-কাণ্ডের তদন্ত রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবিত হয়েছে এবং কোনও কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে বলে বিচারপতি টন্ডন তাঁর রায়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন। কিন্তু, কীসের ভিত্তিতে এই পর্যবেক্ষণ, তা বিচারপতি টন্ডন তাঁর রায়ে উল্লেখ করেননি। ডিভিশন বেঞ্চ আরও জানিয়েছে, সিটের তদন্তে প্রভাব বিস্তারের কোনও প্রমাণের উল্লেখও ওই রায়ে নেই।
ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, আদালতে অভিযোগ করা হয়, এই মামলায় ষড়যন্ত্রের বিষয়টি তদন্ত করে দেখেনি সিট। কিন্তু, তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে আদালতের কাছে সিট যে ক’টি রিপোর্ট পেশ করে, তাতে দেখা গিয়েছে ওই বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখেছে। ডিভিশন বেঞ্চ জানায়, বিচারপতি টন্ডন এই ঘটনার আরও তদন্তের নির্দেশ দেন। কিন্তু কেন? তার কোনও উল্লেখ তিনি তাঁর রায়ে করেননি। সিটের তদন্ত এবং ওই সংক্রান্ত চার্জশিট বিচারপতি টন্ডন খারিজ করেননি বলেও এ দিন জানিয়েছে ডিভিশন বেঞ্চ।
ঘটনার সূত্রপাত গত বছরের পঞ্চায়েত ভোটের সময়। বীরভূমের পাড়ুইয়ের কসবা থেকে নির্দল প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন বিক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মী হৃদয় ঘোষ। নির্বাচনের আগেই ২১ জুলাই রাতে বাঁধ নবগ্রামে তাঁর বাড়িতে চড়াও হয় দুষ্কৃতীরা। তাদের বন্দুকের গুলিতে গুরুতর জখম হন হৃদয়বাবুর বাবা সাগর ঘোষ। তাঁর তলপেটে দু’টি গুলি ঢুকে যায়। গুলি লাগে হাতেও। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে ঘটনার পর দিন অস্ত্রোপচার করেও তাঁর পেটের গুলি বের করা যায়নি। এর দু’দিন পর হাসপাতালেই মৃত্যু হয় তাঁর।
ঘটনাচক্রে, এর চার দিন আগে, অর্থাৎ ১৭ জুলাই কসবায় তৃণমূল একটি জনসভা করে। ওই সভায় রাজ্যের দুই মন্ত্রী মলয় ঘটক এবং চন্দ্রনাথ সিংহের সামনে জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ভোটে দাঁড়ানো নির্দল প্রার্থীদের পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনকে হুমকি দেন। তিনি ওই দিন বলেন, “কসবাতে যদি কোনও নির্দল প্রার্থী কারও বাড়িতে গিয়ে হুমকি দেয়, তার বাড়িটা ভেঙে দিন, জ্বালিয়ে দিন। কোনও নির্দল প্রার্থী যদি কোনও হুমকি দেয়, তার বাড়িতে চড়াও হন এটাই কিন্তু আমি বলতে এসেছি। আপনাদের।” তিনি আরও বলেন, “আর যদি কোনও প্রশাসন ভাবে, নির্দলকে সমর্থন করবে, সেই প্রশাসনের পুলিশের উপর বোমা মারুন। আমি বলছি, বোমা মারতে।”
এর কয়েক দিন পরেই সাগরবাবুর বাড়িতে ওই ভাবে হামলা চালিয়ে, তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলার পর স্বাভাবিক ভাবেই অনুব্রতবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। কিন্তু ঘটনায় জড়িত থাকার সন্দেহে হৃদয়বাবুর ভাগ্নে-সহ চার জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁরা হলেন সাগরবাবুর নাতি প্রিয়রঞ্জন ঘোষ (স্কুল ছাত্র), বাঁধ নবগ্রামের বাসিন্দা নেপাল রায়, তাঁর ভাই নবকৃষ্ণ রায় ও ছেলে মানস রায়। হৃদয়বাবুদের অভিযোগ, পুলিশ নির্দোষদের গ্রেফতার করেছে। কিন্তু পুলিশের তরফে জানানো হয়, ওই পরিবারের করা অভিযোগপত্রেই অভিযুক্ত হিসেবে ধৃতদের নাম ছিল। হৃদয়বাবুর স্ত্রী শিবানীদেবী ওই সময় জানান, পুলিশই জোর করে ওদের নাম লিখতে বলে। না হলে সাগরবাবুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে না বলে হুমকি দেন পাড়ুইয়ের আইসি দৃজরাজ সাহানা। তিনি যদিও এই অভিযোগ নিয়ে সেই সময় কোনও মন্তব্য করেননি।
এর দু’দিন পরে, ২৪ জুলাই বোলপুর ডাকঘর থেকে রেজিস্ট্রি করে অনুব্রতবাবু-সহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে বীরভূমের পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ পাঠান শিবানীদেবী। একই সঙ্গে ওই অভিযোগের প্রতিলিপি পাঠানো হয় মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল, ডিজিপি, বীরভূমের জেলাশাসক ও মানবাধিকার কমিশনকে। অভিযোগপত্রের প্রথম নামটি ছিল অনুব্রতের। এর পর ২৬ জুলাই বীরভূমের মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চক্রবর্তী প্রকাশ্য সভায় উস্কানিমূলক মন্তব্য করার দায়ে অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে পাড়ুই থানাকে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা করার নির্দেশ দেন। যদিও তাতে কোনও কাজ হয়নি। কারণ, অনুব্রত মণ্ডলকে এই ঘটনার দেড় বছর পরও পুলিশ গ্রেফতার করেনি। উল্টে এ বছরের ৪ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে হাজিরা দিয়ে রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডি জানিয়েছেন, সাগর ঘোষ খুনের ঘটনায় অনুব্রত মণ্ডলের কোনও প্রভাব ছিল না।
অন্য দিকে, রাজ্য পুলিশের তদন্তে সন্তুষ্ট না হয়ে এবং নানা মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ তুলে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন হৃদয় ঘোষ-সহ বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতৃত্ব। সাগরবাবুর হত্যার ঘটনায় যে চার জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল, গত বছরের শেষের দিকে তাঁদের তিন জন গোটা ঘটনার সিআইডি তদন্ত চেয়ে কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন করেন। সেই মামলার প্রথম শুনানির দিন পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়। এর পর ২৩ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত ভার সিআইডি-র হাতে তুলে দেয় আদালত। কিন্তু মাস তিনেকের মধ্যেই রাজ্য পুলিশের ডিজিকে মূল তদন্তকারী অফিসার হিসেবে রেখে পাঁচ সদস্যের বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করে দেন হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত। এর পরে মামলা বিভিন্ন বিচারপতির এজলাস ঘুরে বিচারপতি হরিশ টন্ডনের এজলাসে আসে। সিআইডি-সিট পেরিয়ে গত ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি পাড়ুই মামলার তদন্ত সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এ দিন সেই নির্দেশ খারিজ করে ফের সিট-এই ভরসা রাখল বিচারপতি জয়ন্ত বিশ্বাস এবং বিচারপতি ঈশানচন্দ্র দাসের ডিভিশন বেঞ্চ।