ক্যাফের জানলায় তখন আরবি ভাষায় লেখা পতাকা। ছবি: রয়টার্স।
অবশেষে সতেরো ঘণ্টা পর সঙ্কটমুক্ত হলেন সিডনি ক্যাফের পণবন্দিরা। পুলিশ সূত্রে খবর, সমস্ত পণবন্দিকে বাইরে বার করে আনা হয়েছে। এঁদের মধ্যে আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে বন্দুকধারী হারুন মুনিস। ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক সূত্রে খবর, নিরাপদে আছেন পণবন্দি থাকা দুই ভারতীয় বিশ্বকান্ত অঙ্কি রেড্ডি ও পুষ্পেন্দু ঘোষ। রাত ১০টা নাগাদ টুইট করে এ কথা জানান বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ।
সোমবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টা থেকে অস্ট্রেলিয়ার সিডনির একটি ক্যাফেতে পণবন্দি করে রাখা হয়েছিল বেশ কয়েক জনকে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন দুই ভারতীয় পণবন্দি পুষ্পেন্দু ঘোষ ও পেশায় তথ্যপ্রযুক্তিকর্মী বিশ্বকান্ত অঙ্কি রেড্ডি। পণবন্দিদের আটক করে রেখেছিল হারুন মুনিস নামের এক ইরানীয় শরণার্থী। পুলিশ সূত্রে খবর, হারুন মুনিস নামের ওই বন্দুকধারীকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিল অস্ট্রেলীয় সরকার। বন্দুকধারী সরাসরি কোনও মুসলিম সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত কি না তা এখনও নিশ্চিত নয়। মুসলিম মৌলবাদের সঙ্গে এই ঘটনার সম্পর্ক রয়েছে। তবে হারুনের প্রাক্তন আইনজীবীর দাবি, কোনও সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নয়, একাই এ কাণ্ড করেছে হারুন। স্বঘোষিত মুসলিম ধর্মগুরু হিসাবে পরিচিত ওই বন্দুকধারী নিজেকে শেখ হারুন বলে পরিচয় দিত। ২০১৩ সালে আফগানিস্তানে মোতায়েন অস্ট্রেলীয় সেনাদের তিনি ‘হিটলারের সেনা’ বলে অভিহিত করে চিঠিও লিখেছিল বলে দাবি করেছে অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যম। পণবন্দিদের মধ্যে কয়েক জন বন্দুকধারীর আদেশে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁরা জানিয়েছেন, বন্দুকধারী দু’টি দাবি করেছিল।
এক, একটি ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর পতাকা।
দুই, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবট-এর সঙ্গে ফোনে কথা বলা। এতে সন্দেহ আরও দানা বেঁধেছিল। তবে এর মধ্যেই পাঁচ জন বন্দি ক্যাফে থেকে পালিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। তাঁদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এ দিন স্থানীয় সময় সকাল ১০টা নাগাদ মার্টিন প্লেসের একটি ক্যাফেতে এক ব্যক্তিকে ব্যাগ নিয়ে ঢুকতে দেখা গিয়েছিল। কিছু ক্ষণের মধ্যেই খবর রটে যায়, এক বন্দুকধারী ক্যাফেতে থাকা লোকজনকে বন্দি করে রেখেছে। খবর পাওয়া মাত্রই পুলিশের সশস্ত্র বাহিনী এলাকাটিকে ঘিরে ফেলে। এলাকায় যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। খালি করে দেওয়া হয় আশপাশের দোকান, আবাসন এবং অফিসগুলি। বন্ধ করে দেওয়া হয় সংলগ্ন স্টেশনটিও। মোট কত জন বন্দি ছিল অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ তা স্পষ্ট করে জানায়নি। তবে সংবাদমাধ্যমের দাবি, ক্যামেরায় ১৫ জনকে পণবন্দি হিসাবে দেখা গিয়েছে। এক জন বন্দুকধারীকেইও ক্যামেরায় দেখা গিয়েছে। অন্য দিকে, নিরাপত্তার স্বার্থে সিডনির ভারতীয় দূতাবাস ফাঁকা করে দেওয়া হয়। প্রথম দিকে স্থানীয় সূত্রে খবর আসছিল যে পণবন্দিদের মধ্যে কোনও ভারতীয় নেই। কিন্তু এ দিন বেলার দিকে ভারতের সংসদবিষয়ক মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নাইডু জানান, পণবন্দিদের মধ্যে একজন ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী রয়েছেন।
এ দিনের হামলার ঘটনার পর নিরাপত্তা বাড়ানো হয় ভারতীয় ক্রিকেটারদের। ৯ ডিসেম্বর থেকে অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট দল। দলের যাতে কোনও রকম ক্ষতি না হয় সে দিক খেয়াল রেখেই নিরাপত্তার বেষ্টনীতে মুড়ে ফেলা হয় ব্রিসবেনকে। আগামী ১৭ ডিসেম্বর সেখানে দ্বিতীয় টেস্ট খেলবেন ধোনি-কোহলিরা। বিসিসিআইয়ের সচিব সঞ্জয় পটেল জানিয়েছেন, পুরো বিষয়টি তাঁদের নজরে রয়েছ। তিনি আরও জানান, অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ড খেলোয়াড়দের নিরাপত্তার যে ব্যবস্থা করেছে তা সন্তোষজনক।
মার্টিন প্লেসের ক্যাফে চত্বর। ছবি: এএফপি।
বন্দিদের মধ্যে ওই দোকানের কর্মীরাও ছিলেন। ওই ক্যাফের জানালায় তিন জন বন্দিকে আরবি ভাষায় লেখা একটি কালো পতাকা ধরে থাকতে দেখা গিয়েছিল। তবে সেটি ইসলামিক স্টেটের (আইএস) পতাকা নয়। ওই দোকান থেকে দু’দফায় মোট পাঁচ’জন জন বেরিয়ে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েক জন দোকানের কর্মী। কী ভাবে তাঁরা বেরিয়ে এলেন সেই সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায়নি। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে থেকে তথ্য পাওয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবট এ দিন সকালে এই ঘটনায় গভীর আশঙ্কা প্রকাশ করেন। স্থানীয় মানুষকে উদ্বিগ্ন না হওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। অন্য দিকে, এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং অস্ট্রেলিয়ার গ্র্যান্ড মুফতি।
নিউ সাউথ ওয়েলস-এর পুলিশ কমিশনার এই অবস্থার শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে বলে আশ্বাস দেন। তবে অস্ট্রেলিয়ায় এই ধরনের ঘটনার আশঙ্কা ছিলই। অস্ট্রেলিয়া গোয়েন্দা দফতর সূত্রে খবর, প্রায় ৭০ জন অস্ট্রেলীয় আইএস-এর হয়ে লড়াই করছেন। আইএস দমন করতে আমেরিকার জোটে অস্ট্রেলিয়ার প্রায় ছ’শো সেনা লড়াই করেছে। এই সব কারণে, আইএস অস্ট্রেলিয়ায় হামলা চালানোর হুমকিও দিয়ে রেখেছিল। সেই আশঙ্কাই সত্য হল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরেই আইএস-এর সঙ্গে সম্পর্ক রাখার অপরাধে বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করে অস্ট্রেলিয়ার প্রশাসন। সেই রাতে সিডনি ও ব্রিসবেনের বেশ কয়েকটি জায়গায় ব্যাপক অভিযান চালানো হয়। অক্টোবরে সন্ত্রাস দমনের জন্য কড়া আইন নিয়ে আসে অ্যাবট সরকার।
সন্ত্রাসের পথে অস্ট্রেলিয়া
২১ জুলাই, ২০১৪: ইরাকে অস্ট্রেলীয় নাগরিকের আত্মঘাতী বিস্ফোরণ। আইএস-এর হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে লড়াই করা অস্ট্রেলীয়দের সম্পর্কে প্রকাশ্যে এল খবর।
১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪: সন্ত্রাসবাদ নিয়ে চূড়ান্ত সতর্কবার্তা জারি অস্ট্রেলিয়ার প্রশাসনের।
১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪: মধ্যপ্রাচ্যে লড়াইয়ের জন্য ৬০০ সেনা পাঠায় অস্ট্রেলিয়া।
১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪: সিডনি ও ব্রিসবেনে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান চালায় অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ। গ্রেফতার কয়েক জন।
২৯ অক্টোবর, ২০১৪: কড়া সন্ত্রাস বিরোধী আইন জারি করল অস্ট্রেলিয়ার প্রশাসন।