Nachiketa Chakraborty

বোকার মতো একপেশে লিখে গিয়েছি! জ্ঞান হয়েছে, তাই তো গান পাল্টেছে

আমি একক সৎ মানুষ দেখেছি। তাঁর সঙ্গে ঘরও করেছি। তার পরে বুঝেছি, একক সততা দিয়ে রাজনীতি করা যায় না।

Advertisement

নচিকেতা চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০২৪ ১৮:৫২
Share:

ছবি: উপল মোদক।

একটা সত্যি কথা বলব? আমি না এই ভোটের ব্যাপার-স্যাপার কিছুই বুঝতে পারি না। এমন নয় যে আগে বুঝতাম। কোনও কালেই বুঝতাম না। বুঝতে যে চাই না, সেটাও সঠিক নয়। স্কুলজীবনের শেষ দিকে কিছুটা বুঝতাম বলে মনে করতাম। পরে বুঝেছি, সবটাই অর্থহীন, অন্তবিহীন।

Advertisement

আমাদের দেশে ভোটের রাজনীতিটা ঠিক কেমন বলুন তো? রাম চোর! শ্যাম চোর! যদুও চোর! এই তিন চোরের মধ্যে আপনাকে বেছে নিতে হবে এক জনকে। তাকে জেতাতে হবে ভোট দিয়ে। উপায় তো নেই। তাই অপেক্ষাকৃত কম চোর যে, তাকেই বাছি আমরা। ভুল করি হয়তো। কিন্তু ওই যে বললাম, সংসদীয় রাজনীতিতে এর বাইরে ‘খেলা’র মতো কিছু নেই আপনার হাতে।

রাজনীতি এমন একটা ‘গেম’, যেখানে একক সততা দিয়ে টিকে থাকা যায় না। কারণ, বিষয়টাই তো সামগ্রিক। সমষ্টির জন্য। সমষ্টিকে নিয়ে। সে জন্য একক সততার কোনও মূল্য নেই এখানে। কোনও রাজনীতিক যদি বেশি সৎ হন, তা হলে তাঁর নিজের দলের লোকজনই লেঙ্গি মারবে। আর যদি অসৎ হন, তা হলে জনগণ গালাগালি দেবে। আমি একক সৎ মানুষ দেখেছি। তাঁর সঙ্গে ঘরও করেছি। তার পরে বুঝেছি, একক সততা দিয়ে রাজনীতি করা যায় না। যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া না-করলে রাজ্যের সর্বতো উন্নয়ন সম্ভব নয়। এটা আগেও ছিল। এখনও আছে। এই যে সবাই বলেন, গণতন্ত্রের চারটে স্তম্ভ। আমি জানি, রাজনীতিতে এমন স্তম্ভের সংখ্যা অন্তত ৪০০। এই প্রত্যেকটা স্তম্ভকে দাঁড় করাতে গেলে একক সততায় হবে না। হওয়া সম্ভবই নয়।

Advertisement

আরও একটা সত্যি কথা বলি? আসলে সাধারণ মানুষের ভাল করা যায় না। মানুষের ভাল হয়ও না। মানুষ মানুষের উপকার করে না। কারণ, মানুষই তো নিজের ভাল চায় না। এই যে আমি প্রতি দিন এত শো করি, এত মানুষের সঙ্গে মিশে যাই, অনুভূতিতে ঢুকে পড়ি তাদের, ওদের ‘পাল্‌স’টা আমি বুঝতে পারি। ওদের নাড়ি ধরে বুঝি— ওরা যা দেখে, তা-ই বিশ্বাস করে। বিজ্ঞাপনে মজে আছে। ইদানীং মানুষ এত প্রচারে ভুলছে যে বলার কথা নয়। মানুষ নিজেও জানে, তাদের কখনও ভাল হবে না। এই যে এত প্রচার, এত যুদ্ধ, এত বিগ্রহ— সবই নাকি মানুষের ভালর জন্য! কিন্তু আদৌ কি হচ্ছে? সাধারণ মানুষ আসলে কিছু বোঝেই না। আমিও সেই দলেই পড়ি। আমার রুটি তো এই সমাজ থেকেই আসে। ওতেই তো বেঁচে আছি। আসলে সিস্টেমের এই জাঁতাকলে সাধারণ মানুষ ভাল থাকতে পারে না। সাধারণ মানুষ জন্মাবে। মরবে। স্বাভাবিক মৃত্যু না হলেই রাষ্ট্র বলবে, ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’। এটুকুই যথেষ্ট তাদের জন্য।

কয়েক দশক আগে বাবা খুব বলত, জিনিসপত্রের দাম আগুন! হাত ছোঁয়ানো যাচ্ছে না। প্রতি দিন বেড়ে যাচ্ছে। আমৃত্যু এ সবই বলেছেন। আর এখন, সংসার সামলানো আমার স্ত্রী একই কথা বলেন। মাঝখানে কেটে গিয়েছে কয়েক দশক। দাম কমেনি। বেড়েই গিয়েছে। একই সঙ্গে ভাবি, এই দশকগুলিতে জিনিসপত্রের দাম কমানো হবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে কতগুলো ভোট হয়েছে? অগুন্তি! আমাদের কী হয়েছে? কিচ্ছু হয়নি। হবেও না। বাবা এখন বেঁচে থাকলে কে জানে কী বলতেন!

গোটা বিশ্ব জুড়েই জনসংখ্যা কমানোর একটা খেলা চলছে। কিছু মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগে মারা যায়। কিছু মানুষ যুদ্ধে। ভারসাম্য হয় হয়তো। অনেকেই বলেন, পৃথিবীটা পাপে ভরে গিয়েছে। আমি মনে করি, সেই পাপ প্রতি মুহূর্তে মেপে চলেছে প্রকৃতি। রাজনীতির লোকজন পোস্টার লাগিয়ে বলেন, ‘মানুষের ভাল করছি’। এটা ঠিক নয়। আরে যাদের ভাল করছেন, সেই সাধারণ মানুষকে তো আগে নিজের ভাল বুঝতে হবে! নিজের বাড়িটাকে ভাল করতে হবে তাকে। বাড়ির চারপাশ ভাল করতে হবে। পাড়া ভাল করতে হবে। তা নয়। একটা অন্য লোকের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে দিয়েছে। ভোটে তাকে দাঁড় করিয়ে নিজের সব দায় সেরেছে। ওই দাঁড়িয়ে পড়া লোকটি আবার রাজনীতির। আমরা ভাবছি, ওই লোকই সব ভাল সাধন করবেন আমাদের। কচু করবেন। নিজের ভালই যে মানুষ করতে পারে না, সে আবার অন্যের ভাল করবে কী ভাবে! ভোটে দাঁড়ানো ওই লোকও তো আমাদের সমাজ থেকেই উঠে আসা।

একটা জিনিস স্পষ্ট ভাবে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। টাকা ছাড়া রাজনীতি হয় না। রাজনৈতিক দলগুলো টাকা ছাড়া চলতে পারে না। তাকে প্রোমোট করবে কে? টাকা চাই। এ বার এই টাকা কে দেবে? সাধারণ মানুষ? তার তো টাকাই নেই। পরনের কাপড় উঠে যায় মাথায় ঘোমটা দিতে গিয়ে। সে কোথায় পাবে টাকা! অতএব টাকা দেন পুঁজিপতিরা। কিন্তু ওঁরা কি হরিশ্চন্দ্র! নিজেদের লাভ ছাড়া কেন দেবেন টাকা! আর সেটাই হচ্ছে। আমার মাঝেমাঝে মনে হয়, এই সব ভোট-টোট করে লাভ কী! পুঁজিপতিদের হাতেই তো সবটা দিয়ে দিলে হয়। ওঁরাই করুন সব। ওঁরাই করুন মানুষের ভাল।

তবে হ্যাঁ, এই ভোটের হইচই দেখে আমার ভাল লাগে। মানুষ কিছু নিয়ে ব্যস্ত আছে, এটা দেখে আমার আনন্দ হয়। চারদিকে দেখি, বাচ্চাদের বাবা-মা শেখাচ্ছে, ভাল মানুষ হও। আরে হবে কী করে! বই থেকে মুখ তুলতে দেন? বাবা-মায়ের সঙ্গেও তো কোনও বন্ধন তৈরি হয় না সন্তানের। পাশের মানুষকে চিনবে কী ভাবে! বন্ধু হবে কী করে! তার পরে তো অন্যের ভাল করার কথা শিখবে। সন্তানকে বলছি, খেয়েপরে বাঁচতে হবে। সে খাওয়া তো শুধু পেটের ভাবনার জন্য। চিবিয়ে না হয় সেই খাবার খেয়েও নিল। কিন্তু মাথার খাবার কোথায় পাবে? কানের খাবার? মনের খাবার? পায় না। পাচ্ছে না। বাবা-মা তো শেখাচ্ছে না এ সব। আমরা শেখাচ্ছি না। এ রকম করে আমরা চললে ওরা পাবেও না। মানুষ হবে? মোটেও না। রোবট হবে। রোবট!

এ বার কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, তুমি যদি ভাই এত বোঝো, তা হলে ভোটে দাঁড়াও না কেন? সব ঝক্কির সমাধান তুমিই করো না বাপু! না আমি ‘বাপুজি’ নই। আমি মার্কসিস্ট। মানে দাঁড়াল কী? আমি ‘কমিউনিস্ট’। হ্যাঁ, আমি তাই। তবে ‘প্রাইভেট কমিউনিস্ট’। মার্ক্স তো ভোটে দাঁড়ানোর কথা বলেননি। সংসদীয় গণতন্ত্রে উনি বিশ্বাস করতেন না। পাঁচটা লোক যখন একটা ব্যাঙ্কে গিয়ে লুটপাট করে, আমরা সেটাকে ডাকাতি বলি। আর পাঁচ হাজার লোক যখন সংসদে ঢুকে গদি উল্টে দেয়, সেটাকে ‘বিপ্লব’ বলে। কাজ তো একই। মানুষ নিজেদের স্বার্থে, নিজেদের মহান বোঝাতে একটা করে ‘মাহাত্ম্যপূর্ণ’ নাম দেয়। রাষ্ট্রযন্ত্র কিন্তু একই ভাবে চলছে। স্তালিনের আমলে চলেছে। লেনিনের আমলে চলেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে চলেছে। নরেন্দ্র মোদীর আমলেও চলছে।

আগে এ সব নিয়ে প্রতিবাদ করতাম। গান লিখতাম। তখন বয়স কম ছিল। রক্ত গরম ছিল। এই বয়সে এসে বুঝি, বোকার মতো একপেশে লিখেছি। জ্ঞান হয়েছে। তাই এখন লিখি, ‘তোকে বোঝাই রে কোন মনে/ তুইও সঠিক/ আমিও সঠিক/ তফাত দৃষ্টিকোণে’।

তবে এই ঝড় থেমে যাবে। এটাই আমার বিশ্বাস। এক দিন না এক দিন তো থামবেই। কী ভাবে? আসলে আমাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত, নিজেকে জানা। নিজেকে প্রশ্ন করা, আমার কতটা প্রয়োজন? কী কী প্রয়োজন? লিও তলস্তয়ের সেই গল্পটা মনে আছে? যেখানে বলা হচ্ছে, একটা মানুষের মাত্র সাত ফুট জায়গার প্রয়োজন। মৃত্যুর পরে। আমাদের প্রয়োজন কত কম! এত মারামারি করার কোনও দরকারই নেই। নিজের প্রয়োজন মানুষ কমাতে পারে। কিন্তু চারপাশে এত লোভের হাতছানি! মানুষকে সারা ক্ষণ লোভ দেখাচ্ছে। কোম্পানিগুলোকে বিজ্ঞাপন করতেই হয়। বাজার ধরতে হবে তাকে। আমাকেও জানতে হবে, আমার কতটা প্রয়োজন। কী প্রয়োজন।

এ ভাবেই মানুষ নিজেকে জানুক। পাশের মানুষকে জানুক। ভাবুক, আমি ওর জায়গায় থাকলে কী করতাম? সেটা হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কোম্পানি তো আমাকে বলে দিতে পারবে না, আপনি এটায় ভাল থাকবেন! আমার ভাল আমাকেই খুঁজে নিতে হবে।

তার পরেই না হয় সকলে মিলে গাইব: এক দিন ঝড় থেমে যাবে/ পৃথিবী আবার শান্ত হবে।

(লেখক জীবনমুখী গায়ক ও সুরকার। মতামত নিজস্ব)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement