Lok Sabha Election 2024

মমতা-নীতি ও অভিষেকের সেনাপতিত্বেই আস্থা বাংলার! সাড়া নেই মোদীর দুর্নীতি-সন্দেশখালি অস্ত্রে

গত বিধানসভা নির্বাচনে বিরাট জয়ের পর থেকেই একাধিক দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। চাকরি থেকে রেশন ‘দুর্নীতি’, জেলে গিয়েছেন রাজ্যের কয়েক জন নেতা-মন্ত্রী।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২৪ ০১:৩৩
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

আস্থা অটুট। গত তিন বছরে সরকার ও দলের বিরুদ্ধে এত দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও মমতা-অভিষেকেই আস্থা রাখল বাংলা। প্রায় সব ক’টি বুথ ফেরত সমীক্ষাকেই উল্টে দিয়ে রাজ্যের ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে ২৯টিই দখল করল তৃণমূল। বিজেপির ঝুলিতে গেল ১২টি আসন। কংগ্রেস পেল মাত্রটি একটি।

Advertisement

গত বিধানসভা নির্বাচনে বিরাট জয়ের পর থেকেই একাধিক দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। চাকরি থেকে রেশন ‘দুর্নীতি’, জেলে গিয়েছেন রাজ্যের কয়েক জন নেতা-মন্ত্রী। সেই দুর্নীতির অস্ত্রে শান দিয়ে লোকসভা ভোটে প্রচারের সুর বেঁধেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাজ্যের নেতা শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদারেরা। তার সঙ্গে জুড়ে ছিল সন্দেশখালির ‘ক্ষোভ’! কিন্তু ভোটে তার ছাপ দেখা গেল না। শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতার জনআকর্ষণী ক্ষমতা, তাঁর সরকারের লক্ষ্মীর ভান্ডার-সহ একাধিক জনমোহিনী প্রকল্প এবং দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাংগঠনিক ‘দক্ষতা’র উপর ভর করে লোকসভা ভোটের বৈতরণীও পার করল শাসকদল।

সন্দেশখালি যে লোকসভা আসনের মধ্যে পড়ে, সেই বসিরহাট কেন্দ্রেই তিন লাখের বেশি ভোটে জিতলেন তৃণমূল প্রার্থী হাজির নুরুল। হারলেন বিজেপি প্রার্থী রেখা পাত্র। রেখা সন্দেশখালিরই ভূমিকন্যা। তাঁকে প্রার্থী করে শুধু বসিরহাট কেন্দ্র নয়, সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে গোটা রাজ্যেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রচারে ঝড় তুলতে চেয়েছিল বিজেপি। তা যে কাজে এল না, ভোটের ফলাফলেই তা স্পষ্ট। যদিও সন্দেশখালি বিধানসভায় আট হাজারের বেশি ভোটে এগিয়ে ছিলেন রেখা।

Advertisement

মঙ্গলবার দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে যে ফলাফল হল বাংলায়, তাতে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পরে আরও এক বার দলের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল সেনাপতি অভিষেকের নেতৃত্ব। প্রতিষ্ঠিত হল সামগ্রিক ভাবে বাংলার রাজনীতিতেও। দেখা গেল কৌশল, সংগঠন, প্রচার, অভিমুখ নির্ধারিত করা— সব ক্ষেত্রেই বিজেপিকে কয়েক যোজন পিছনে ফেলে দিলেন অভিষেক। বুথফেরত সমীক্ষা যখন দেখিয়েছিল, বাংলায় তৃণমূলের ‘ভরাডুবি’ হতে চলেছে, তখন দলের প্রার্থী, জেলা সভাপতিদের নিয়ে বৈঠক করে তিনিই বলেছিলেন, ‘চোয়াল শক্ত’ রাখতে। তৃণমূল কমবেশি ৩০টা আসন জিতবে। নিজের ভবিষ্যদ্বাণী মিলিয়ে দেওয়ার পাশাপাশিই তিনি সম্মুখসমরে কার্যত পাঁচ গোল মারলেন শুভেন্দু অধিকারীকে! ‘সেনাপতি’ থেকে হয়ে উঠেছেন ‘ক্যাপ্টেন’।

সন্দেশখালি এবং শেখ শাহজাহান নিয়ে যখন গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে রাজ্য রাজনীতি তোলপাড়, তখন অভিষেকই সামনে থেকে দলের লাইন ঠিক করে দিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, সন্দেশখালির যে আখ্যান নিয়ে বিজেপি এবং তার সহযোগীরা ভোটের ময়দানে নেমেছিল, একটি ‘স্টিং ভিডিয়ো’ তা পুরোপুরি ঘুরিয়ে দিয়েছে। সমাজমাধ্যমের প্রচারেও অভিষেকের তৃণমূল অনেকটা এগিয়ে থেকেছে শুভেন্দুর আইটি সেলের থেকে। সন্দেশখালির গোপন ক্যামেরা অভিযানের ‘ফুটেজ’ নিয়ে তৃণমূলের আইটি সেল যে প্রচার করেছিল, তা-ও ধারণা নির্মাণে কাজ করেছে।

ভোটের প্রচার পর্বে অভিষেকের বক্তৃতায় নির্দিষ্ট ‘অভিমুখ’ ছিল। যে অভিমুখ কখনও ঘুরে যায়নি। দেখা গিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহেরা বাংলায় এসে তৃণমূলের বিরুদ্ধে যা যা বলেছিলেন, তার পাল্টা বলছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেক সে ভাবে মোদী-শাহদের জবাব দেওয়ার পথে হাঁটেননি। তিনি শুধু তুলনামূলক রাজনৈতিক পরিসংখ্যান তুলে ধরে আক্রমণ শানিয়েছিলেন বিজেপিকে। তাঁর বক্তব্যের মূল উপজীব্য ছিল— মমতার সরকার কী কী দিচ্ছে বাংলার জনগণকে। বাংলার মানুষের কী কী ‘প্রাপ্য’ আটকে রেখেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। যে প্রাপ্য আদায়ের দাবি নিয়ে গত বছর সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে আন্দোলন নিয়ে গিয়েছিলেন অভিষেক। তার পর রাজধানীতে ধর্না, অবস্থান-বিক্ষোভ, পুলিশি ধরপাকড় এবং শেষে কলকাতায় ফিরে রাজভবনের সামনে ধর্নায় বসে পড়া— অন্য অভিষেককে দেখেছিল বাংলা।

অনেকের বক্তব্য, বিজেপির হয়ে অনেকটা একই রকম ভূমিকা নিয়েছিলেন শুভেন্দু। যে কারণে দু’জনের তুলনা আরও বেশি করে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে প্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছিল। দু’জনেরই পরীক্ষা ছিল এই ভোট। অভিষেক ফার্স্ট বয় হয়েছেন। শুভেন্দু ফেল! ভোটের ফল নিয়ে দু’জনের দাবি প্রায় এক ছিল। শুভেন্দু বলেছিলেন, সংখ্যা তিনি বলবেন না। তবে তৃণমূলের থেকে একটি হলেও বেশি আসন পাবে বিজেপি। অর্থাৎ, তৃণমূল যদি ২০টি পায়, তা হলে বিজেপি অন্তত ২১টি আসন পাবে। অন্য দিকে, ষষ্ঠ দফার ভোটের পরে অভিষেক বলেছিলেন, ‘‘আগের বার ২২টা পেয়েছিলাম। পৃথিবী রসাতলে গেলেও ২৩টা এ বার পাবই।’’ দেখা গেল, অভিষেক তাঁর অনুমান বাস্তবায়িত করতে পেরেছেন। অভিষেক নিজে সাত লাখের বেশি ভোটে ডায়মন্ড হারবার থেকে জিতে তৃতীয় বার সাংসদ হলেন।

এ বার রাজ্যের একাধিক আসনের ফলাফলের দিকে নজর ছিল। তার মধ্যে অন্যতম হল বহরমপুর। সেখানকার তৃণমূল প্রার্থী ইউসুফ পাঠানের কাছে হারলেন পাঁচ বারের কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী। ইউসুফ বহরমপুরে প্রার্থী বড় চমক দিয়েছিলেন মমতা-অভিষেক। সেই কৌশল কাজেও লেগে গেল। মমতা বলেন, ‘‘ওঁর (অধীর) ঔদ্ধত্যই এর জন্য দায়ী। আর উনি বিজেপির লোক। পাঠানকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা। ওঁকে আমরা আমন্ত্রণ করেছিলাম। উনি সেটা গ্রহণ করে মর্যাদা দিয়েছেন।’’ ভোটে হারের পর অধীরের অভিযোগ, জাতপাতের রাজনীতির কাছে হার হল তাঁর। তিনি ‘স্যান্ডউইচ’ হয়েছেন! তাঁর কথায়, ‘‘বাংলার রাজনীতি ক্রমশ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি যারা আছে, তাদের জন্য নির্বাচন কঠিন হচ্ছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ভোট ঠিকঠাক হয়েছিল। আমাদের চেষ্টার কোনও ত্রুটি ছিল না। পর পর পাঁচ বার জিতেছিলাম। মানুষের দোয়া-আশীর্বাদের ত্রুটি ছিল না। মানুষ মনে করছিল জেতানো দরকার, জিতিয়েছিল। এখন মনে করেছে যে কোনও দরকার নেই, তাই জেতায়নি। কিন্তু নির্বাচন তো নির্বাচন। হেরেছি মানে হেরেছি। আমি ইউসুফ পাঠানের কাছে পরাজিত হয়েছি, ইউসুফকে জয়ের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আমি স্যান্ডউইচ হয়েছি। এক দিকে, হিন্দু ভোটের বিভাজন, অন্য দিকে মুসলিম ভোটের বিভাজন। আমি হিন্দু হতে পারিনি। মুসলিমও হতে পারিনি।’’

বর্ধমান-দুর্গাপুরে তৃণমূলের আর এক ক্রিকেটার প্রার্থী কীর্তি আজ়াদ বিজেপির প্রাক্তন রাজ্যসভা দিলীপ ঘোষকে হারিয়ে দিয়েছেন। শাসকদলের আর এক তারকা প্রার্থী শত্রুঘ্ন সিন্হাও জিতেছেন আসানসোলে। কৃষ্ণনগরে তৃণমূলের মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে রাজবধূ অমৃতা রায়কে প্রার্থী করেছিল বিজেপি। সংখ্যালঘু ভোট সিপিএমে চলে যেতে পারে, এই আশঙ্কা থেকে মহুয়া হেরে যেতে পারেন বলে জল্পনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শেষ হাসি মহুয়াই হাসলেন। হুগলিতে বিজেপির লকেট চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তৃণমূল প্রার্থী করেছিল অভিনেত্রী রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সেখানে রচনাই জিতলেন। ঘাটালে বিজেপির হিরণ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়েছেন তৃণমূলের দেব।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement