Adhir Chowdhury

প্রচারে বেরোলেই অধীর শুনছেন ‘গো ব্যাক’! ক্ষোভ স্বতঃস্ফূর্ত? না কি ঘাসফুল এবং পদ্মের ভোট কৌশল?

সমর্থকদের ভোট যাতে অধীরের দিকে ‘সুইং’ না করে, সে জন্য বিরোধিতা তীব্র করছে বিজেপি। ‘অধীর কোনও ফ্যাক্টর নয়’, তৃণমূল প্রমাণ করতে সক্রিয়। তাই কি কংগ্রেস প্রার্থীকে ঘিরে বার বার বিক্ষোভ?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

বহরমপুর শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:১০
Share:

অধীর চৌধুরী এবং তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ। —ফাইল চিত্র।

নবাবের শহর তাঁকে ‘রবিনহুড’ খেতাব দিয়েছে। কংগ্রেসের অভিযোগ, বহরমপুর-সহ গোটা মু্র্শিদাবাদ জেলাতেই প্রাক্তন বিধায়ক এবং পাঁচ বারের সাংসদ অধীর চৌধুরীকে শুনতে হচ্ছে ‘গো ব্যাক’ স্লোগান! প্রচারে বেরিয়ে প্রায় প্রতি দিনই বাধার মুখে পড়ছেন বহরমপুরের কংগ্রেস প্রার্থী। কোথাও দেওয়া হচ্ছে স্লোগান। কোথাও প্রচারের গাড়ি আটকে দেওয়া হচ্ছে। ভোটের লড়াইয়ে নেমে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি আগে কখনও হননি অধীর। তাই মাঝেমাঝে মেজাজও হারাতে দেখা যাচ্ছে তাঁকে। কিন্তু, অধীরকে ঘিরে এই বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ কি স্বতঃস্ফূর্ত? না কি এর পিছনে রয়েছে শাসকদলের নির্বাচনী কৌশল?

Advertisement

বহরমপুর পুর এলাকায় জল প্রকল্পের উদ্বোধনে গিয়ে প্রথম বার অধীরকে শুনতে হয়েছিল ‘গো-ব্যাক’ আওয়াজ। তখন সবে ঘোষণা হয়েছে নির্বাচনী নির্ঘণ্ট। তার পর ফের বেলডাঙা, নওদা, কান্দি, এমনকি অধীরের ‘খাসতালুক’ বহরমপুর পুরসভা এলাকাতেও একই ভাবে বাধার মুখে পড়ছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে তৃণমূল যেমন রয়েছে, তেমন আছে বিজেপিও। তবে সেটা সংখ্যায় কম। নির্বাচনের মুখে প্রধান দুই প্রতিপক্ষের ‘কায়দা’ প্রায় একই। এই বিক্ষোভ যে আদতে ‘কৌশল’, বিজেপি এবং তৃণমূলের ভোটকুশলীরা প্রকাশ্যে না-বললেও ব্যক্তিগত আলোচনায় তাতে সিলমোহর দিচ্ছেন।

বিধানসভার নিরিখে বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে উঠে এসেছে বিজেপি। ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে ‘অধীর গড়ে’ কংগ্রেসকে তৃতীয় স্থানে নামিয়ে এনেছে দুই দল। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বহরমপুর কেন্দ্রে অধীর পঞ্চম বার জয়ী হয়েছিলেন বটে, কিন্তু লড়াই করতে হয়েছে। ভোট পরিসংখ্যানে কংগ্রেসের ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছিল তৃণমূল। আর ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে অধীরের ‘হাতের তালু’ বহরমপুর সদর বিধানসভায় তো পদ্ম ফুটিয়েছে বিজেপি। এত দিন সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠদের বহরমপুরে প্রার্থী করে এসেছে বিজেপি। কিন্তু এ বার ভোটে মুর্শিদাবাদ জেলায় পরিচিত ‘ডাক্তারবাবু’ নির্মল সাহাকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। অন্য দিকে, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বহরমপুরে এ বারই প্রথম ‘সংখ্যালঘু মুখের’ মুখোমুখি হতে হচ্ছে অধীরকে। সৌজন্যে তৃণমূল। প্রার্থী ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠান।

Advertisement

বিগত পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, বিধানসভা ভোটে বিজেপি সমর্থকদের একটি বড় অংশ ভোটের বাক্সে অধীরের পক্ষেই থেকেছেন। তাই নিজেদের ভোট যাতে অধীরের দিকে ‘সুইং’ না করে, সে জন্য ধর্মীয় মেরুকরণ থেকে অধীর-বিরোধিতা তীব্র করছে বিজেপি। বহরমপুরে দলের নিচুতলার কর্মী-সমর্থকদের প্রতি বিজেপির বার্তা, তৃণমূলকে হারানো নয়, এ বার জয়ের লক্ষ্যে লড়তে হবে। তাই কংগ্রেস প্রার্থীকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে সঙ্গেই অধীর-বিরোধিতা স্পষ্ট করতে চাইছে জেলা বিজেপি। বস্তুত, মুর্শিদাবাদ বিজেপি জেলা নেতৃত্বের সম্পর্কে দীর্ঘ দিন ধরেই দলের কর্মীদের একাংশের অনুযোগ এই যে, নেতারা ভোটে কার্যত নিষ্ক্রিয় থেকে অধীরকে জিততে সহায়তাই করেন। এ বার কি সেই ‘বদনাম’ ঘোচাতেই এই বিক্ষোভ এবং বাধা? মুর্শিদাবাদ জেলা বিজেপির সাংগঠনিক সভাপতি শাখারভ সরকারের জবাব, ‘‘এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অধীর চৌধুরী দীর্ঘ দিন ধরে দলের ঊর্ধ্বে উঠে নিজস্ব ক্যারিশমায় জনসমর্থন নিজের দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছেন। আমাদের সমর্থকেরাও তৃণমূলকে আটকাতে অধীরবাবুকে ভোট দিয়েছেন। এটাও সত্যি। কিন্তু, এ বার আমরা নতুন কৌশলে এগোচ্ছি। সেটা হল, শুধু তৃণমূলকে রুখে দেওয়াই নয়, বহরমপুর আসনটিতে আমাদের জয় নিশ্চিত করা।’’

অধীর গড়’ মুর্শিদাবাদের আর একটি লোকসভা আসনে প্রার্থী হয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। ‘অধীরের প্রার্থী সেলিম’— মুর্শিদাবাদ লোকসভার অলিগলিতে এটাই এখন ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’। এ ভাবেই প্রচার হচ্ছে। সেলিমের মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় তাঁর পাশাপাশি হেঁটেছেন অধীর। কিন্তু ডোমকল, রানিনগর, জলঙ্গি, নওদা, হরিহরপাড়ার মতো বিধানসভা আসনে দীর্ঘ দিন ধরে বামেদের প্রধান প্রতিপক্ষই ছিল কংগ্রেস। অন্য বিধানসভাগুলিতে ফরওয়ার্ড ব্লক এবং আরএসপির মতো বাম শরিকদের সঙ্গে লড়াই হলেও প্রধান তিনটি বিধানসভায় কংগ্রেসের সরাসরি লড়াই ছিল সিপিএমের সঙ্গে। ডোমকল, জলঙ্গি এবং রানিনগরে বাম-কংগ্রেস সংঘর্ষে প্রাণহানির সংখ্যাও নেহাত কম নয়। সেই প্রজন্ম এখন রাজনীতিতে সক্রিয় না হলেও স্বজন হারানোর স্মৃতি নতুন প্রজন্মের কাউকে কাউকে ছুঁয়ে গিয়েছে। তাই ‘উঁচু তলায়’ আসন সমঝোতা বাম এবং কংগ্রেসের তৃণমূল স্তরের সাধারণ কর্মীদের একাংশ এখনও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মানতে পারেননি। আর সেটা বেশ ভালই অনুধাবন করেছেন অধীর। তিনি নিজেও জানেন একমাত্র তাঁর অতিসক্রিয়তা এবং বিধানসভা ভিত্তিক কংগ্রেসের সংগঠনিক শক্তিই পারে ‘অভিমানী’ কংগ্রেস কর্মীদের জোট রাজনীতির লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করতে। আর মুর্শিদাবাদে কংগ্রেস সমর্থকদের সমর্থন পেতে সেলিমের একমাত্র চাবিকাঠি অধীরের হাতেই। ঠিক এই অঙ্ক কষেই বহরমপুরের কংগ্রেস প্রার্থীকে তাঁর কেন্দ্রেই আটকে রাখতে চাইছে তৃণমূল।

অধীর নিজের কেন্দ্রে বিভিন্ন জায়গায় প্রচারে বেরিয়ে বিক্ষোভের সম্মুখীন হচ্ছেন। তাই নিজের কেন্দ্র নিয়ে বেশি করে সক্রিয় হচ্ছেন কংগ্রেস প্রার্থী। প্রচারে জোর বাড়াচ্ছে কংগ্রেস। আবার জেলা তৃণমূলের এক নেতার দাবি, অধীরকে ঘিরে একাধিক জায়গায় বিক্ষোভের ছবি তুলে ধরে কংগ্রেস কর্মীদের মনোবলকে দুর্বল করে দেওয়াই তাঁদের লক্ষ্য। এমনকি, রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে থাকা শুধু অধীরের সমর্থকদের তাঁদের প্রিয় নেতার জয় যে এ বার সহজ নয়, সেই বার্তা দিতে চাইছে ঘাসফুল শিবির। তাই বিভিন্ন বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অধীরকে ব্যস্ত রেখে তাঁর প্রচার পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়াই তৃণমূলের অন্যতম ভোট কৌশল। শুধু তা-ই নয়, ঠান্ডা মাথায় ‘ভোট মেশিনারি’ পরিচালনা করা অধীরকে ব্যক্তিগত স্তরে আক্রমণ করে মেজাজ ‘বিগড়ে’ দিতে চাইছে তৃণমূল। যাতে কৌশলী অধীরের ‘চালে’ ভুল হয়। সব মিলিয়ে অধীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এ বার নতুন অঙ্ক কষে ‘খেলা হবে’ বলছে তৃণমূল। অধীরের বিরুদ্ধে তৃণমূলের বিক্ষোভ প্রসঙ্গে মুর্শিদাবাদ সাংগঠনিক জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান নিয়ামত শেখের প্রতিক্রিয়া, ‘‘বিক্ষোভ এবং স্লোগান তো রাজনৈতিক কর্মসূচির অঙ্গ। এক দলের নেতাকে অন্য দলের কর্মীরা বিক্ষোভ দেখাবেন, এতে তো অস্বাভাবিকত্বের কিছু নেই। কিন্তু তিনি কতটা শান্ত থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলা করবেন, সেটাই তো রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘অধীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে যে কায়দায় তৃণমূল প্রচার শুরু করেছে, তাতে আগে নিজের কেন্দ্র সামলে তবেই না মুর্শিদাবাদে নজর দেবেন উনি।’’ যদিও বহরমপুর কংগ্রেস নেতৃত্বের দাবি, এই বিক্ষোভ, বাধা ভোটারদের কোনও ভাবেই প্রভাবিত করবে না। বরং ‘বুমেরাং’ হবে। কারণ, বহরমপুরের সাধারণ মানুষের কাছে অধীর ‘এখনও রবিনহুড’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন