ভোট করানো

পিওন থেকে গেজেটেড অফিসার— সব কিসিমের সরকারি কর্মচারীই ভোট করাতে যান। দূরেও যেতে হয়, এ জন্য ট্রেনিংও নিতে হয়। একটা করে বুথ থাকে এক জন প্রিসাইডিং অফিসারের অধীনে, এবং তাঁর অধীনে থাকেন কয়েক জন করে পোলিং অফিসার।

Advertisement

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৬ ১৭:২৯
Share:

পিওন থেকে গেজেটেড অফিসার— সব কিসিমের সরকারি কর্মচারীই ভোট করাতে যান। দূরেও যেতে হয়, এ জন্য ট্রেনিংও নিতে হয়। একটা করে বুথ থাকে এক জন প্রিসাইডিং অফিসারের অধীনে, এবং তাঁর অধীনে থাকেন কয়েক জন করে পোলিং অফিসার। পোলিং অফিসাররাই আঙুলে কালি মাখান, নামের পাশে দাগ দেন। নিজেদের অফিসে ওঁরা পিওন হতে পারেন, গ্রুপ ‘ডি’ হতে পারেন, কিন্তু ভোটকেন্দ্রে অফিসার। এ রকম কয়েকটা বুথের দায়িত্বে থাকেন এক জন সেক্টর অফিসার, তাঁর উপরে রিটার্নিং অফিসার। একটি রাজ্যের সার্বিক দায়িত্বে থাকেন চিফ ইলেকশন অফিসার। এবং সবার উপরে চিফ ইলেকশন কমিশনার, যিনি এখন নসীম জৈদি। নির্বাচন পরিচালনা এবং সম্পাদন করার এ রকম একটা বিধিব্যবস্থা এবং কাঠামো গঠন আমাদের সংবিধানে রয়েছে। এই কর্ম সম্পাদনের জন্য যাঁরা ভার পেতেন, তাঁরা বলতেন, ‘ভোট করাতে যাচ্ছি’। লক্ষ করেছি গত দু’তিনটি নির্বাচনে ওঁরা এ কথাটা বলছেন না। বলছেন, ‘‘ভোটের ডিউটিতে যাচ্ছি।’’ কারণ ‘ভোট করানো’ শব্দবন্ধটাকে হাইজ্যাক করে নিয়েছেন ভোট-প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা। ভোট বিশারদ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের প্রবল ভোট-চেতনাই ভোটে জেতানোর নানা রকম কূটকৌশল, ফন্দিফিকির তৈরি করে। এবং কৌশল-সমৃদ্ধ অ্যাকশন সমূহকে বলা হয় ‘ভোট করানো’। এ রকম কিছু পটু ভোট-করিয়ে আছেন। এঁরা কেউ স্বশিক্ষিত, কেউ বা উপযুক্ত গুরুর যোগ্য চেলা। এদের নব নব উদ্ভাবনে নির্বাচন কমিশন পর্যুদস্ত হয়ে যায়।

Advertisement

টাকা তোলা, বোমা বাঁধা, দেয়াল দখল, পোস্টার লেখা— এগুলো ভোট করানোর সিলেবাসে থাকলেও ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হল বুথের চরিত্র অনুযায়ী চরিত্র ঠিক করা। কোথায় ভিড় তৈরি করে ভোটারদের ভোট দিতে অনীহা তৈরি করতে হবে, যাকে বলে জ্যামিং, কোথায় দু’একটা বোম চার্জ করে সন্ত্রস্ত করতে হবে, কী ধরনের বোম, ক’টা ব্যবহার করতে হবে, ফস্কা, না ফুটুস...! ফস্কায় ধোঁয়া বেশি, ফুটুসে শব্দ। এ ছাড়া স্প্লিন্টার সমৃদ্ধ প্রাণঘাতী বোমাও আছে। স্টকে রাখতে হয়, খুব দরকার পড়লে ব্যবহার করতে হয়। কোন বুথ বাবুসোনা, মানে নিজের দলের পক্ষে নিরাপদ। ওখানে কোনও ঝামেলা নয়, ম্যান পাওয়ার অপচয় নয়। কোন বুথ ঠিক কোন সময়ে দখল করে নিয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যে পটাপট ভোট দিয়ে দেওয়া সম্ভব...এটার নাম ছাপ্পা ভোট। ই-ভি-এম আসার আগে প্রার্থীর নামের পাশের প্রতীক চিহ্নে রবার স্ট্যাম্পের ছাপ দিতে হত। সেই থেকেই ছাপ্পা ভোট কথাটা ভোট করানোর জারগনে রয়ে গেছে। ‘প্রক্সি’ আগে খুবই প্রচলিত ছিল। আঙুলের কালি ওঠাবার নানা রকম পন্থাও উদ্ভাবিত হয়েছিল। ভোটার কার্ড প্রচলন হবার পর এই প্রথা ততটা কাজ দিচ্ছে না। হুইপিং নামে ভোট করানোর একটা পদ্ধতি আছে। যার মানে কিছু ভোটারকে ভয় দেখিয়ে কোনও নির্দিষ্ট প্রার্থীকেই ভোট দিতে বাধ্য করা। হুই হুই হল এর একটা স্তর, মানে একটা বাইক মিছিল ঘ্যাঁক ঘ্যাঁক করতে করতে একটা রাস্তা দিয়ে চলে গেল। এটা এক ধরনের শক্তি প্রদর্শন। দ্বিতীয় ধাপ হল দু’এক জন পেশীধারী বা অস্ত্রধারী সম্ভাব্য বিপক্ষ ভোটারের বাড়ি গিয়ে বলে আসবে— কাকে ভোট দিচ্ছিস সেটা কিন্তু আমরা ঠিক জানতে পারি। এ ছাড়া দরকার মনে করলে ভোটের সপ্তাহখানেক আগে দু’একটা বাড়িতে আগুন। বাইরের প্যারামিলিটারি পিচরাস্তায় যতই খটাখট করুক না কেন, হুই হুই বন্ধ করা সম্ভব নয়। এমন অনেক গ্রাম আছে যেখানে গাড়িই ঢোকে না। ওরা যদি হেঁটেও যান, কত ক্ষণ থাকবেন? আর এই ভয় দেখানোর কাজটা চলে খুব ঘরোয়া কায়দায়, যা বাইরের লোকের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। ভয় না দেখিয়ে লোভ দেখিয়েও ভোট আদায় করা যায়। ৪০-৫০ বছর আগে সমাজবাদের লোভ দেখিয়ে ভোট টানা যেত। ওটা একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এখন আধুনিকতার যুগ। লোভের ফাঁদ পাতা নানা ভাবে হতে পারে, এ সব পাকামাথার কাজ।

গণতন্ত্র নিয়ে স্কুলপাঠ্য রচনা লিখতে গেলে আমরা লিখব: নির্বাচন হল গণতন্ত্রের মহোৎসব। মহোৎসব শব্দটাকে তুচ্ছার্থে মোচ্ছব বলি আমরা।

Advertisement

ভোটে যাঁরা জেতেন, সেখানে যে সব সময় নির্বাচকদের ইচ্ছাতেই যেতেন এমন মনে হয় না আর। অনেক ক্ষেত্রেই ‘ভোট করানো’র প্রক্রিয়ার সাফল্য-অসাফল্যের কারণেই হারজিত নির্ভর করে। যখন যে দলের হাতে ক্ষমতা থাকে, ভোট করিয়ে নেওয়াটা তাদের পক্ষে সহজতর হয়। তাঁরা ক্ষমতাবলে ভয় দেখানো এবং লোভ দেখানো— দুটো অস্ত্রই ব্যবহার করতে পারেন।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কোনও বিকল্প উন্নততর ব্যবস্থা আমাদের জানা নেই। কিন্তু গত ২০-২৫ বছরের নির্বাচন দেখে মনে হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের প্রতিফলন এই নির্বাচন ব্যবস্থায় অন্তত পশ্চিমবঙ্গে হয় না। কিন্তু কেরল, গোয়া, দিল্লি, ওড়িশা— এই সব অনেক রাজ্যেই তুলনায় সুষ্ঠু ও সুস্থ ভোট হয়। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্ত সংখ্যালঘু। মধ্যবিত্ত শ্রেণির বৃদ্ধির হারও কম। কর্মসংস্থান নেই। বিরাট সংখ্যক তরুণ দালালি, কমিশন সংগ্রাহক, ফড়েগিরি, অটো-টোটো ইত্যাদি চালানো, সফ্ট তোলাবাজি— এ সব করে পয়সা রোজগার করছে। এ সব কাজে মাথার ওপর একটা দাদার ছাতা দরকার হয় (দিদিরও হতে পারে)। এবং যাঁরা ভোট করান, তাঁরা এদের যথেচ্ছ ব্যবহার করেন। এই অবস্থার বদল না হলে ঠিকঠাক ভোট কী করে হবে আমি জানি না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন