গণতন্ত্রের সব থেকে বড় দিক হল নির্বাচন। আমরা ভোটের দিন কী দেখি? দেখি, ভোট দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মানুষ বুথের বাইরে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন। দেশের প্রথম নাগরিক, অর্থাৎ রাষ্ট্রপতিকেও লাইনে দাঁড়িয়েই ভোট দিতে হয়। ভোটের দিন রাষ্ট্রপতি এবং দেশের সাধারণ এক জন মানুষ একই লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেন। সে দিন ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে সবার হাতে একই ক্ষমতা। সংবিধান অনুযায়ী কেউ ছোট বা কেউ বড় নন সে দিন। বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশে একই নিয়ম। কিন্তু বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতবর্ষ, তাই তাৎপর্য আরও একটু বেশি। ভোটকে নিয়ে এত উন্মাদনা অন্যান্য দেশে খুব একটা নজরে পড়ে না। আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশেও ভোটের ছ’মাস আগে সরকারকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তা হয় না। গণতান্ত্রিক পরিবেশে এই দেশে ভোট-পর্ব পরিচালিত হয়। ব্যতিক্রম শুধু বাংলা। আগে আমরা দেখতাম ভোটের দিন মারামারি, সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটত। এখন প্রায় সব রাজ্যেই ভোটের দিনের চিত্রটি ইতিবাচক হলেও বাংলা সম্পুর্ণ বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে। বর্তমানে বাংলায় ভোটের দিন ঘটে চরম সন্ত্রাস। ধীরে ধীরে বাংলা গণতন্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন একটি রাজ্যে পরিণত হয়েছে। দেশের সব জায়গায় শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোট হলেও, এই রাজ্যে ভোটের দিন দেখতে হয়, বিরোধীদের রক্তে লাল হয় বুথ। আর এই রাজ্যে বিপুল পরিমাণ হিংসাত্মক ঘটনা ঘটার জন্য নির্বাচন কমিশন এতগুলি দফায় ভোট করাচ্ছেন। তামিলনাড়ুতে তো এক দফায় ভোট হচ্ছে। অসমে উচ্চ ও নিম্ন অসমের মধ্যে সমস্যা থাকার কারণে দু’দফায় ভোট হচ্ছে। সেখানে বাংলায় সাত দিনে ভোট হচ্ছে। ২০০৬ সালে ভোট হল পাঁচ দিনে। ২০০৯ সালে ছ’দিনে। দিন দিন বাংলায় ভোটের পরিবেশ ঘোরালো হয়ে উঠছে। আর নির্বাচন কমিশন বুঝতে পারছে বাংলায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ নেই। রাজ্যে এই রকম পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য বর্তমান শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস যেমন দায়ী, ঠিক তেমনই বামদলও দায়ী। বিহারে যেখানে ভোটের সময় বিপুল সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটত, সেখানেও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হল। বিহারে বিজেপি হেরেছে, কিন্তু ভোট তো নির্বিঘ্নে হয়েছে। কিন্তু বাংলায় শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হতে পারবে না কেন?
বাংলায় এটা কেন হয়? প্রত্যেক দল থেকে স্লোগান তোলা হচ্ছে, ‘নিজের ভোট নিজে দিন’! সেটাই তো স্বাভাবিক। মানুষ নিজের ভোট নিজেই তো দেবে। যখন এই ধরনের ঢালাও প্রচার চালানো হয়, তখন বুঝতে হবে যে, এই রাজ্যের অনেক ভোটারই নিজের ভোট নিজে দিতে পারেন না। যখন তৃণমূল বিরোধী আসনে ছিল, তখন ভোট লুঠের অভিযোগ জানাতো। এখন সেই দলই বিরোধীদের ভোট লুঠ করছে। এটা বাংলার দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই না। যেখানে তিন দিনের ভোট হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। আর ভোটের দিনগুলিতে দেখা গিয়েছে নির্বিচারে তৃণমূলের ক্যাডাররা ভোট চুরি করেছে। অভিনব কায়দায় ভোট করাচ্ছে তৃণমল। কিছু কিছু জায়গায় তৃণমূলের ক্যাডাররা ইভিএম-এ দলীয় প্রতীকের বোতামের উপর বোরোলিন লাগিয়ে রাখছে। বুথ থেকে বেরোলে ভোটারদের আঙুলে বোরোলিনের গন্ধ রয়েছে কি না, তারও বিচার চলছে। আর ভোটারদের আঙুলে বোরোলিনের গন্ধ না থাকলে কপালে জুটছে চরম প্রহার। ভোট লুঠ করার জন্য মাথা থেকে নতুন নতুন ভাবনার সৃষ্টি করছে তৃণমূল। এই সব অভিনব ভাবনা যদি রাজ্যের উন্নয়নের কাজে লাগাতো, তা হলে সাধারণ মানুষের এত খারাপ দশা থাকত না। একটা শাসক দলকে এই সব করতে হচ্ছে, উন্নয়ন না করার জন্য। মুখে মা-মাটি-মানুষের সরকার বললেও মানুযকে শোষণ করা ছাড়া আর কোনও কিছুই করছেন না এই রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী। আবার মমতাদেবীর স্নেহধন্য অনুব্রত মণ্ডল ভোটারদের চমকানো ধমকানোর সংগঠনটা বেশ ভালই করেন। আর তৃণমূল সুপ্রিমোর প্রশ্রয় পেয়ে বাড়বাড়ন্ত হয়েছে কেষ্টবাবুর।
বাংলায় এখনও অনেক গ্রাম আছে, যেখানকার মানুষের কাছে এক ঠোঙা মুড়ি আর চপ একটি ভোটের থেকে অনেক বেশি দামি। আর সেই সুযোগটাই নিচ্ছে শাসকদল। গরিব ভোটারদের কোথাও মুড়ি-বাতাসা, কোথাও বা মুড়ি-ঘুগনি খাইয়ে, তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
নতুন ভোটারদের কাছে কী দৃষ্টান্ত রাখছেন শাসকদলের নেতারা? সন্তানের কাছেও কি তাঁদের মুখ পুড়ছে না? ওই সব নেতার সন্তানেরা দেখছে, তাঁদের বাবা-মায়েরা ভোট লুঠ করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হচ্ছেন। ক্ষমতার লোভে মানুষের প্রাণ নিতেও পিছপা হচ্ছেন না। আবার নিজেদের জনপ্রতিনিধি বলে বেড়াবেন তাঁরা। সেই সব নেতার কাছে আমার প্রশ্ন, ‘লজ্জা লাগবে না, সন্তানের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে? সারাজীবন কী শিক্ষা পাবে সেই সন্তানেরা?’
এই রাজ্যে চৌত্রিশ বছর একই সরকার রাজত্ব চালিয়ে গেছে। তার মানেটা এটাই দাঁড়ায় যে, এই রাজ্যে গণতন্ত্র নেই। আর বিগত পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা সরকারও স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়েই রাজ্যশাসন করেছে। ক্ষমতায় থাকার মোহে সমাজব্যবস্থা, নীতিবোধ সব ভেঙে যাচ্ছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বাইরে কোথাও যাবেন, তখন যদি কেউ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি কি ভোট লুঠ করে ক্ষমতায় এসেছেন?’
তখন তিনি কি কোনও উত্তর দিতে পারবেন? নাকি তাঁকেও মাওবাদী বলে চুপ করানোর চেষ্টা করবেন? যে রাজ্যে পাঁচ বছর আগেও জ্বলন্ত সমস্যা ছিল মাওবাদীদের বাড়বাড়ন্ত। কোন জাদুতে এই রাজ্যে মাওবাদী সমস্যা ভ্যানিশ হয়ে গেল? এটা কিন্তু খুবই ভাবনার বিষয়। এই যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন ‘জঙ্গল হাসছে’! মাওবাদীরা তাঁর দলে ভিড়ে যাওয়াতেই জঙ্গল হাসছে। যারা চিহ্নিত মাওবাদী, তারা পায়ে হেঁটে মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের দরজার সামনে বিনা বাধায় চলে গেলেন আত্মসমর্পণ করতে। এই নাটক বুঝতে রাজ্যের মানুষের আর কী বাকি আছে? বোধ হয় না। মাওবাদীদের বাড়-বাড়ন্তের সুযোগ করে দিয়েছিল বাম সরকার। ‘রাজনৈতিক ভাবে সমস্যা সমাধান করা হবে’-এই কথা বারংবার বলে কঠোর হাতে মাওবাদী সমস্যা সমাধান করতে পারেনি। আর তৃণমূলে এসে জুটেছে মাওবাদীরা। ‘পাহাড় হাসছে’- এই কথাও খুব বলতেন দিদি। এখন আর বলেন না। কেননা তিনি দেখলেন, পাহাড়ে ষে দল শক্তিশালী, সেই দল তৃণমূলকে খুব একটা পাত্তা দিতে রাজি নয়। তখন তিনি পাহাড়ে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’-রাজনীতির আমদানি ঘটালেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশে এই ধরনের নীতি তো সবচেয়ে লজ্জার।
চৌত্রিশ বছর ‘সর্বহারা’র দল রাজ্যের প্রতিটি মানুষের মাথায় একুশ হাজার টাকার ঋণ চাপিয়েছে। সেই ঋণের বোঝা বাড়িয়ে একত্রিশ হাজার টাকা করেছেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী। সৌজন্যে: উৎসব, জলসা, ক্লাবের জন্য দান-খয়রাতি, মোচ্ছব। রাজ্যের মানুষ পরিবর্তন চাইলেও, আদপে কি পরিবর্তন হল?
এই রাজ্যে সংখ্যালঘুদের অবস্থা এত খারাপ কেন? এখানে তো কোনও সাম্প্রদায়িক দল নেই। তা হলে এত খারাপ অবস্থা কেন তাদের? সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলিম ভোটার রয়েছে ডোমকলে। আর তাদের আর্থিক অবস্থাও সবচেয়ে খারাপ। এখন তৃণমূলের সাংসদরাই বলে বেড়াচ্ছেন। ‘তোমাদের সাহায্য করেছি- এ বার ভোট দাও।’ নারদ স্টিং ভিডিও মানুষের সামনে চলে আসায় এই রাজ্যের নেতা-মন্ত্রীদের আসল চেহারাগুলো সামনে চলে এসেছে। মানুষ দেখছে কী ভাবে টাকার বিনিময়ে বিকিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। এর পরেও তাঁরা ভাবেন, বাংলার মানুষ তাঁদের উপর ভরসা রাখবেন? অন্য দিকে, তৃণমূলের নেতা সব্যসাচী দত্তের সিন্ডিকেট-রাজের চিত্র ভিডিও’র মাধ্যমে মানুষ দেখে নিয়েছে। আর বুঝেও নিয়েছে যে, তৃণমূল দলটির মূল ভিত্তিই হল সিন্ডিকেট-রাজ। রাজ্যের বেকারদের জন্য কোনও কর্মসংস্থান নেই। আর সেই কারণেই বেকার যুবকদের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে সিন্ডিকেট ব্যবসায় নামাচ্ছেন। বিভিন্ন সভামঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, তাঁর দলের নেতারা দুর্নীতিগ্রস্ত। তাই তাঁকে বলতে হচ্ছে, ‘চড় মারুন কিন্তু ভোটটা তৃণমূলকেই দিন।’ কিন্তু আপনার দলের দু্র্নীতিগ্রস্ত নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? মানুষ মরছে আর নেতারা টাকা গুনতেই ব্যাস্ত। দুর্নীতি আর নয়। এ বারের ভোটে সাধারণ মানুষ জবাব চাইবে সব প্রতারণার।