‘কী দিনকাল পড়ল রে বাবা! হাতে টাকা নিয়ে কেউ বলছেন, ‘লটস অফ মানি’, কেউ আবার টাকা নিয়ে চাদরে মুড়ে রাখছেন। মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকার জন্য কত কেতা! তা-ও যদি সৎপথে রোজগার হতো। নিচ্ছিস তো বাবা ঘুষ!’— চায়ের দোকানে ঢুকেই টিপ্পনিটা ছুড়ে দিলেন বছর ত্রিশের এক যুবক। পরনে জিন্স আর হলুদ রঙের টি-শার্ট।
বেজার মুখে কেটলি থেকে গরম চা ঢালতে ঢালতে প্রৌঢ় দোকানদারও বিড়বিড় করছেন, ‘‘এই শুরু হল! ভরসন্ধ্যায় গণেশকে এখনও ধূপধুনো দিতে পারলাম না। আর বাবুরা নারদ-নারদ করে এখন দেশ উদ্ধার করবে!’’
‘নাহ্, কাকা। তুমি একদম বাধা দেবে না। ও যে বড় বড় কথা বলছে। এখনও কি প্রমাণ হয়েছে যে, ভিডিওটা জাল না আসল। মনে হল, আর কারও সম্পর্কে চাট্টি নিন্দা করে দিলাম, অপমান করলাম। এটা তো হতে পারে না।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে হাঁফাচ্ছেন চায়ের দোকানে বসে থাকা আর এক যুবক। তৃণমূলের কট্টর সমর্থক হিসাবে যাঁকে চায়ের দোকানের সবাই চেনেন। আক্রমণের লক্ষ্য হলুদ টি-শার্ট।
চায়ের গেলাসটা ঠক করে কাঠের বেঞ্চের উপরে রেখে হলুদ টি-শার্ট হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘ওরে এটা প্রযুক্তির যুগ। টিভির পর্দায় কেমন ঝকঝকে ছবি দেখা যাচ্ছে! ক্যামেরা কখনও মিথ্যে বলে না। তার পরেও আবার প্রমাণের কী আছে রে? এই তো, সুস্মিতদা চলে এসেছে...’’
সেই মোক্ষম সময় দোকানে ঢুকে যে কী ভুল করেছিলাম! পেশার কারণে চারপাশের এক-আধটু খোঁজ-খবর রাখি বটে। তাই বলে ভিডিও জাল না কি আসল সে বিচার করা তো আমার কম্ম নয়। তাঁদের বুঝিয়ে বললাম বটে। কিন্তু তর্ক থামল না। যুক্তি, পাল্টা যুক্তিতে গরম হয়ে ওঠে আলোচনা। কাপের পর কাপ উড়ে যায় চা। রাত যত বাড়ে, চড়তে থাকে গলার আওয়াজ। বসন্তের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে ভোটের আলোচনায়।
শুধু কৃষ্ণনগরের নয়। মফস্সল, গাঁয়ে-গঞ্জে এখন একটাই আলোচনা, নারদ-কাণ্ড। তাই বলে জোট প্রসঙ্গও কিন্তু এক্কেবারে মিইয়ে যায়নি। কেউ কেউ আবার নারদ-কাণ্ডকে ফুৎকারে উড়িয়ে বলছেন, ‘‘শুনুন দাদা, এই নারদ-টারদে কিস্যু হবে না। নজর রাখতে হবে জোটের দিকে।’’ ঘুষের কথা বলতেই যেমন ঝাঁঝিয়ে উঠলেন ভীমপুরের নতুন বিশ্বাস (নাম পরিবর্তিত)।
বছর পঞ্চাশের নতুনবাবু বলছেন, ‘‘সারদার মতো এত বড় একটা দুর্নীতির পরেও ভোট-বাক্সে কোনও প্রভাব পড়েনি। নারদে আর কী এমন হবে। এ সবের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়— জোট। মমতার কাছে মূল আতঙ্ক এখন এটাই। দেখছেন না, নানা সভায় এখন জোট নিয়ে মমতা অনেক কথা বলছেন। কিন্তু সকলেই বুঝতে পারছেন এই জোট-জুজুতে তৃণমূলনেত্রী বেশ কিছুটা চাপে রয়েছেন। ফলে কংগ্রেস ও সিপিএমের জোটটা যদি ঠিকটাক হয়ে যায়, তাহলেই খেলা জমে যাবে।’’
একই কথা শোনা গেল চাপড়া ব্লক অফিসের সামনে। সেখানেও জোট নিয়ে জোর আলোচনা। আদৌ কংগ্রেস বা সিপিএমের সব ভোটার অন্য প্রতীকে ভোট দিতে রাজি হবেন কি না তা নিয়েও তর্ক চলছে। চাপড়ায় এ বার সিপিএম প্রার্থী দিয়েছে। যদিও প্রথম থেকে এই আসনটির দাবি করেছিলেন কংগ্রেসের স্থানীয় নেতৃত্ব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত না পেয়ে প্রথম দিকে তাঁদের অনেকই হতাশ হন। তবে কোনও ভাবেই তাঁরা জোট বিরোধী নন।
কংগ্রেস কর্মীদের কথায়, ‘‘তৃণমূল সরকারে আসার আগে এই চাপড়ায় কিন্তু আমরা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলাম। সিংহভাগ গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি আমাদের দখলেই ছিল। কিন্তু তৃণমূল এসে তো আমাদের দলটাকেই প্রায় তুলে দেওয়া চেষ্টা করে যাচ্ছে। দলটাই যদি না থাকে তা হলে আর প্রতীক নিয়ে ভেবে কী লাভ?’’
এটা বুঝেছেন দুই দলের কর্মীরাও। আর সেই কারণেই সিপিএম-কংগ্রেস কর্মীরা ঝান্ডা নিয়ে কৃষ্ণনগর (দক্ষিণ), কৃষ্ণনগর (উত্তর), নাকাশিপাড়া, কালীগঞ্জ, হরিণঘাটা, কল্যাণীর মতো নানা এলাকায় মিছিল ও পাড়ায় পাড়ায় প্রচার শুরু করেছেন। দেওয়াল লেখাও শুরু হয়েছে একসঙ্গে।
কর্মীদের দাবি, নদিয়াতে ১৭টির মধ্যে এ বার অন্তত ১০টি আসনে সরাসরি লড়াইয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই সম্ভাবনা যতই তৈরি হচ্ছে ততই যেন ক্ষোভ অভিমান ভুলে আরও কাছাকাছি আসছেন দুই দলের কর্মীরা। আর তৃণমূলের নেতারা মুখে যাই বলুন না কেন, এই জোট যে ঘাড়ের উপরে নিশ্বাস ফেলছে সেটা বুঝতে পারছেন তাঁরাও। সঙ্গে দোসর আবার নারদ!
সান্ধ্য আড্ডা থেকে চায়ের দোকান, তুফানি তর্ক যেন থামছেই না। আজি ভোট জাগ্রত দ্বারে!