গ্রামগঞ্জে এমনটা হয়। বিরোধীদের ঠান্ডা করতে সন্ত্রাস চালায় শাসকের বাহিনী। এ বার এমন ছবি দেখল কলকাতাও। দক্ষিণ শহরতলির মানুষ দেখলেন শাসকের বাহিনী কী ভাবে সন্ত্রস্ত করল শান্ত পাড়াকে। ভাঙচুর করলো একের পর এক বাড়িতে। সঙ্গে মারধর, ইটবৃষ্টি। তাদের হামলায় আহত হলেন ১০ সিপিএম নেতা-সমর্থক।
শনিবার ভোট মিটতেই পূর্ব বেহালা কেন্দ্রে আক্রান্ত হন বিরোধী প্রার্থীর এজেন্ট ও তাঁর পরিবার। শনিবারই হামলা হয় বালিগঞ্জের পেয়ারাবাগান বস্তিতে জোট সমর্থকদের বাড়িতে। রবিবার হামলা হয়েছে বাঘা যতীন এবং কসবায়। বাঘা যতীনে একটা নির্দিষ্ট এলাকায় টানা দু’ঘণ্টা ধরে কয়েকটি বাড়িতে হামলা হয়েছে। আর কসবায় হামলা হয়েছে সিপিএমের দলীয় অফিসে। সেখানে এক সিপিএম কর্মীকে বিবস্ত্র করে মারধরের অভিযোগ উঠেছে।
বাঘা যতীনের ওই এলাকায় হামলার কারণ নিয়ে এলাকার পুরনো বাসিন্দারা বলছেন, বিধানসভা ভোটের দিন কলকাতা পুরসভার ১০১ নম্বর ওয়ার্ডের ওই পাড়ায় সিপিএম এজেন্টদের বুথ ছাড়া করতে পারেনি তৃণমূল। পাশাপাশি পুলিশ আর কেন্দ্রীয় বাহিনী সক্রিয় হওয়ায় বাইরে থেকে ছেলেও ঢোকাতে পারেনি তারা।
১৯৮৫ সালে কলকাতা পুরসভার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকেই ১০১ নম্বর ওয়ার্ডের দখল রেখেছে সিপিএম। ২০১১ সালে যাদবপুর বিধানসভায় হেরে গেলেও এখানে এগিয়ে ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনেও সিপিএমকে লিড দিয়েছে এই ওয়ার্ড। গত বছর পুর নির্বাচনে প্রথম ওয়ার্ডটি হাতছাড়া হয় সিপিএমের। অভিযোগ, সে বার বাইরে থেকে প্রচুর ছেলে এনে তৃণমূল ভোট করিয়েছিল। সিপিএম এজেন্টরা বসতেই পারেননি একাধিক বুথে। শনিবারের ভোটে সেই ছবিটা বদলেছে। তৃণমূলের আশঙ্কা, পুরভোটে জিতলেও ওই ওয়ার্ডে এ বার লিড পাবেন না তৃণমূলের প্রার্থী বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত। সেই কারণেই আক্রোশে তারা এমন হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ।
গোটা ওয়ার্ডের এই এলাকাটিকেই হামলার জন্য বাছা হল কেন? স্থানীয়রা বলছেন, প্রথমত এলাকাটি ১০১ নম্বর ওয়ার্ড অফিসের লাগোয়া। ওখানেই বসেন তৃণমূল কাউন্সিলর বাপ্পাদিত্য দাশগুপ্ত। দ্বিতীয়ত সিপিএম লোকাল কমিটির সম্পাদক বুদ্ধদেব ঘোষ থাকেন ওই পাড়ায়। জি-ব্লকে থাকেন সিপিএম প্রার্থী সুজন চক্রবর্তীর এজেন্ট সুজন দত্ত। ওয়ার্ড অফিসের গা ঘেঁসে সিপিএম কর্মী কমল মজুমদারের বাড়ি। যাঁর বাড়ি থেকে ওয়ার্ড অফিস সংলগ্ন বুথটি পরিচালনা করেছিল সিপিএম। ওই বুথে এজেন্টও ছিলেন কমল।
স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, রবিবার রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বাইক বাহিনী প্রথমে জড়ো হয় ফুলবাগানে একটি নির্মীয়মাণ বাড়ির একতলায়। পাশেই তৃণমূলের নির্বাচনী কার্যালয়। বাইক রেখে তারা প্রথমে পৌঁছয় ফুলবাগান মেলার মাঠে। সেখান থেকেই ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের খবর, হামলাকারীরা বহিরাগত, এসেছিল নাকতলা এবং রাজপুর-সোনারপুর এলাকার বোড়াল, রেনিয়া থেকে।
হামলা হয়েছে ফুলবাগান রোডে সুজয় সাহা, বুদ্ধদেব ঘোষ ও গৌরচন্দ্র সাহার বাড়িতে। তার পরে দুষ্কৃতীরা হানা দেয় কেন্দুয়া রোডে সুশান্ত নস্করের বাড়িতে। বাদ যায়নি সুজন দত্তের বাড়িও।
হামলায় কমলের হাতের হাড়ে চিড় ধরেছে। তাঁর ছেলে, দশম শ্রেণির ছাত্র অর্ণব বলে, ‘‘ইট মেরে বাড়ির সমস্ত জানালার কাঁচ ভেঙে দিল, রড আর বাঁশ দিয়ে মেরে ভেঙে দিল জলের সব পাইপও। বাবাকে সামনে পেয়ে মারতে থাকে।’’ কমল বলেন, ‘‘আমাকে বুথে বসতে না করছিল ওরা। আমি গ্রাহ্য করিনি। শনিবার কয়েকটি ফল্স ভোটও আটকেছি।’’
সিপিএম নেতা বুদ্ধদেব ঘোষ হামলার সময়ে বাড়িতে ছিলেন না। তাঁর মা মায়ারানি ঘোষের কথায়, ‘‘হঠাৎ বাইরে ‘মার, মার’ চিৎকার। তার পর ঘরের মধ্যে একের পর এক আধলা ইট পড়তে থাকে।’’ বুদ্ধবাবু বলেন, ‘‘গত পুর নির্বাচনে ওরা ভোট লুঠ করলেও এ বার কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকায় সেটা করতে পারেনি। সেটাই ওদের রাগের কারণ।’’
ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর বাপ্পাদিত্য দাশগুপ্তের পাল্টা অভিযোগ, ‘‘সিপিএম নেতাদের প্ররোচনায় ওঁদের ছেলেরাই পাড়া জুড়ে তাণ্ডব চালায়। থামাতে গিয়ে আমাদের কয়েক জন কর্মী আহত হন।’’ বাপ্পাদিত্য তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ। পার্থবাবু বলেন, ‘‘এ সবে আমাকে জড়ানো কেন? আমি কিছু জানি না।’’
কসবার হামলা
পুরসভার ৯১ ওয়ার্ডে বোসপুকুর বাজারের কাছে সিপিএমের দলীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর ও এক দলীয় কর্মীকে বিবস্ত্র করে মারধর করার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। বরাবরের বামঘাঁটি ওই ওয়ার্ডটি গত পুরভোটে তৃণমূলের তুমুল সন্ত্রাসেও নিজেদের দখলে রেখেছে সিপিএম। সে কারণেই তৃণমূল হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ। তৃণমূল অবশ্য হামলার কথা অস্বীকার করেছে। দু’পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে। যাদবপুর ও কসবার ঘটনা প্রসঙ্গে কলকাতা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (সদর) সুপ্রতিম সরকার বলেন, ‘‘দু’পক্ষই অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ করেছে। তদন্ত চলছে। যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ যদিও সোমবার রাত পর্যন্ত কোনও ঘটনাতেই কেউ ধরা পড়েনি।