হুঁশিয়ারি নয়, আর্তি মমতার

এ বার অন্তত ভোটটা দিন

তৃণমূলনেত্রীর মুর্শিদাবাদ সফর দরদর করে ঘামছেন। ধবধবে পাঞ্জাবিটা পিঠের সঙ্গে লেপ্টে গিয়েছে। মাউথপিসটা মুখের কাছে ধরে থাকা ভদ্রলোকের গলা কাঁপছে— ‘‘প্লিজ, ওসিকে বার বার অনুরোধ করছি...এসডিপিও সাহেব আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন, গাড়িগুলো ছেড়ে দিন, ওঁরা মাঠে ঢুকতে পারছেন না, ফাঁকা মাঠ খুব খারাপ লাগছে দেখতে।’’

Advertisement

বিমান হাজরা

সাগরদিঘি শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৬ ০২:২৭
Share:

কাজ করছে মাইক? ডোমকলে গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

দরদর করে ঘামছেন। ধবধবে পাঞ্জাবিটা পিঠের সঙ্গে লেপ্টে গিয়েছে। মাউথপিসটা মুখের কাছে ধরে থাকা ভদ্রলোকের গলা কাঁপছে— ‘‘প্লিজ, ওসিকে বার বার অনুরোধ করছি...এসডিপিও সাহেব আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন, গাড়িগুলো ছেড়ে দিন, ওঁরা মাঠে ঢুকতে পারছেন না, ফাঁকা মাঠ খুব খারাপ লাগছে দেখতে।’’

Advertisement

সুব্রত সাহা। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী। তার চেয়েও বড় পরিচয়, কংগ্রেসের গড়, মুর্শিদাবাদ থেকে শাসক দলের এক মাত্র প্রতিনিধি হয়ে তিনিই গিয়েছিলেন বিধানসভায়। পুরস্কার দিতে কার্পণ্য করেননি মমতা, পালাবদলের পরে মৎস্য দফতরের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তাঁকেই ডেকে নিয়েছিলেন তিনি।

সেই সুব্রত এ বারও সাগরদিঘির প্রার্থী। তবে সেই দাপট আর নেই। টোল খেয়েছে দিদির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটাও। সাগরদিঘির গোষ্ঠী কোন্দলে ক্ষতবিক্ষত সুব্রতর প্রচার সভায় মমতাও প্রথমে আসতে চাননি। দলের অন্দরের খবর, ‘না না ওখানে য়েতে পারব না’ বলে তালিকা থেকে একরকম বাতিল করেই দিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের এই প্রান্তিক কেন্দ্রটি। দলীয় পর্যবেক্ষক শুভেন্দু অধিকারীর শেষ মুহূর্তের হস্তক্ষেপে সূচী বদলে সাগরদিঘি ফের তালিকায় ঢোকে। হারানো বল বুকে ফিরেছিল তাঁর। কিন্তু, মঙ্গলবার বৈশাখের ভরা দুপুরে সাগরদিঘির মাঠ ভরানোর জন্য খোদ প্রার্থীর কাকুতি মিনতি শুনে দলেরই এক ওজনদার নেতা বলছেন, ‘‘বোঝা যাচ্ছে দিদি এলেও সাগরদিঘি ধরে রাখা কঠিণ।’’

Advertisement

বেলা দেড়টা নাগাদ মমতার হেলিকপ্টার নামার পরে মাঠটা আড়াআড়ি ভরানোর একটা শেষ চেষ্টা করেছিলেন দলীয় নেতারা। তবে পুলিশের হিসেব বলছে, সাড়ে তিন হাজারের বেশি লোক হয়নি।

গোষ্ঠী বিবাদে দীর্ণ সাগরদিঘিতে মাঠ যে ভরবে না, অনুমানটা ছিলই। দলের এক জেলা নেতা বলেন, ‘‘সুব্রতকে প্রার্থী না করার জন্য দিদির পিসতুতো ভাই-ই তো উঠে পড়ে লেগেছেন। স্থানীয় কর্মীরাও ওঁকে চাইছেন না। ওই সিটটা আমরা ছেড়েই রেখেছি।’’

এ দিন ম়ঞ্চ থেকে মমতাও হুঁশিয়ারি দিয়ে গিয়েছেন, ‘‘তৃণমূল কংগ্রেসে থেকেও যারা এখানে বিরোধিতা করছে তাদের সব কটাকে আমি এই মঞ্চ থেকেই বহিষ্কার করে গেলাম।” সঙ্গে ছিল সুব্রত জন্য শুকনো শংসাপত্রও—“এত কাজ করার পরেও সুব্রত যদি সাগরদিঘিতে জিততে না পারে তাহলে তার থেকে লজ্জার কিছু নেই।” তবে তাতে কার কী এল গেল?

সাগরদিঘির ওই বিক্ষুব্ধরা অবশ্য আগেই পদত্যাগ করেছিলেন দলীয় পদ থেকে। ইস্তফা দিয়েই তাঁদের কেউ বা নির্দল হয়ে দাঁডি়য়ে পড়েছেন সুব্রতর বিরুদ্ধে। তাঁদেরই এক জন বলছেন, ‘‘আর কতবার বহিষ্কার করার এই মস্করা চলবে?’’

দলীয় সূত্রে খবর, মাঠ ভরাতে না পারায় সুব্রতর উপরে এ দিন বেজায় চটেছেন দলনেত্রী। এক জেলা নেতা, যিনি সর্বক্ষণ ‘দিদি’র সঙ্গী ছিলেন, বলছেন, ‘‘দিদির কথা শুনলেন না, দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ের আশঙ্কার কথা প্রায় কবুলই করে ফেললেন তিনি। মানুষ কী তা বুঝল না!’’

তবে সাগরদিঘির সঙ্গে তাঁর যে পুরনো একটা সম্পর্ক রয়েছে, এ দিন তা-ও মনে করিয়ে দিয়েছেন মমতা। তিনি বলেন, “সাগরদিঘি আমার খুব পরিচিত জায়গা। আমি ছোট্টবেলায় সাগরদিঘিতে খুব আসতাম। বীরভূম আমার মামার বাড়ি। তার লাগোয়া এই সাগরদিঘি আমার মায়ের মামার বাড়ি। তাই সাগরদিঘিতে আমার অনেকবার আসার সুযোগ হয়েছে। ”


মাঠ ভরল না। —নিজস্ব চিত্র

দলের ‘মিরজাফর’দের পাশাপাশি তৃণমূল নেত্রী অবশ্য এ দিন স্বাভাবসিদ্ধ ভাবেই মুখর ছিলেন জোটের বিরুদ্ধে। বলছেন, “মুর্শিদাবাদের কংগ্রেস নেতারা নির্বাচনে জিততে পারবেন না বলে এখন সিপিএমের কোলে বসে দোল খাচ্ছেন। একটা দুটো মিরজাফর সব জায়গাতেই থাকে। সাগরদিঘিতেও আছে। সেটাকে পাত্তা দিতে নেই, ছেঁটে বাদ দিয়ে দিতে হয়।’’ তিনি জানান, মালদহে এ বারে কংগ্রেস গোহারা হারবে। তবে মুর্শিদাবাদেরর ব্যাপারে ভবিষ্যৎবাণী করতে গিয়ে অবশ্য সতর্ক হচ্ছেন তিনি—‘‘এখানেও বদলের সময় হয়েছে, মনে রাখবেন।’’ সেই সুরটা ধরে রাখছেন, পরবর্তী ডোমকল কিংবা হরিহরপাড়ার সভাতেও। দলীয় নেতারা তাঁর কথায় খুঁজে পাচ্ছেন, হুঁশিয়ারি নয়, বরং মুর্সিদাবাদের মানুষের কাছে আকুতি— এত দিনেও এখানকার মানুষকে প্রতীক চেনাতে পারিনি। এ বার অন্তত প্রতীক চিনে ভোটটা দিন।’’ তার কথায়, ‘‘মুর্শিদাবাদে পঞ্চায়েত দেন নি, জেলা পরিষদ দেননি। এমনকী লোকসভাতেও জিততে পারিনি। বিধানসভায় একটি মাত্র আসনে জিতিয়েছেন। তাও জেলার উন্নয়নে বৈষম্য করিনি। এ বার পরিবর্তন আনুন। আমি মুর্শিদাবাদের বিপদের দিনে বার বার ছুটে এসেছি মনে রাখবেন।’’

আর বিদায় বেলায় ভরা মাঠ দেখে ফের ফিরে যাচ্ছেন পুরনো মেজাজে। ডোমকলের মাঠে তাই বলছেন, ‘‘লজ্জা হয়, এক সময় কংগ্রেস করতাম বলে। ডোমকল, রানীনগর ও জলঙ্গিতে উন্নয়ন কংগ্রেস ও সিপিএমের গুন্ডাদের দিয়ে করব না। উন্নয়ন হতে পারে তৃণমূলের প্রার্থীদের দিয়েই। এটা মনে রাখবেন।’’সেই চেনা হুঁশিয়ারি না আকুতি— মুর্শিদাবাদ মমতাকে কীভাবে মনে রাখে এখন দেখার সেটাই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন