জোড়াসাঁকো থানা থেকে বেরোচ্ছেন শুভাশিস রায়চৌধুরী (বাঁ দিকে) ও আমিনুর রহমান। ছবি: রণজিৎ নন্দী
পুলিশের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ হরদম ওঠে। কিন্তু পুলিশের ঘুষ দিতে চাওয়া! তাও আবার এক রাজনৈতিক নেতাকে! নারদ-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে সে অভিযোগও উঠল।
সোমবার দুপুরে নবান্নের তেরো তলায় আচমকাই হুড়মুড়িয়ে ঢুকলেন পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার। নির্বাচন কমিশনের ফুল বেঞ্চের সঙ্গে তখন প্রশাসনিক কর্তাদের একটি ভিডিও কনফারেন্স হওয়ার তোড়জোড় চলছে সেখানে। উপস্থিত রয়েছেন মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বরাষ্ট্রসচিব মলয় দে এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডি। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো রাজীব তাঁদের জানালেন, স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের দুই গোয়েন্দা কর্মী ঘুষ দিতে গিয়ে ধরা পড়েছেন! ওই ঘরে উপস্থিত এক কর্তা পরে ঘনিষ্ঠ মহলে বলছিলেন, ঘটনাটি বলার সময় বেশ অস্থির দেখাচ্ছিল কমিশনারকে। পারতপক্ষে কারও চোখে চোখ রাখছিলেন না। কখনও ডিজি-কে, কখনও বাসুদেববাবুর উদ্দেশে, কখনও বা স্বরাষ্ট্রসচিবকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, ওই ঘটনার সঙ্গে বাহিনীর কোনও সম্পর্ক নেই। সংশ্লিষ্ট দুই পুলিশ কর্মী যা করেছেন, ব্যক্তিগত ভাবে করেছেন!
প্রশাসনিক কর্তাদের কিন্তু বড় অংশের মনেই প্রশ্ন, শীর্ষস্তরের সম্মতি ছাড়া কোনও স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের কর্মী এমন কাজ করার সাহস পাবেন কি? এর পিছনে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতে পারে বলেই মনে করছেন তাঁরা। কী সেই পরিকল্পনা? নবান্নের এক কর্তার কথায়, ‘‘নারদ কাণ্ড থেকে নজর ঘোরাতে এটা পাল্টা হুলের পরিকল্পনা হতে পারে।’’
এ সবের কিছু ক্ষণ পরেই সাংবাদিক সম্মেলন করলেন বিজেপি-র কেন্দ্রীয় সম্পাদক রাহুল সিংহ। প্রকাশ্যে অভিযোগ আনলেন, দলের রাজ্য দফতরে বসেই হাতেনাতে ধরেছেন ঘুষ দিতে আসা কলকাতা পুলিশের দুই কর্মীকে! তাঁর দাবি, ‘‘নারদ-হুলে বিদ্ধ তৃণমূল নেত্রীই বিজেপি-কে ফাঁসানোর জন্য ঘুষের পাল্টা চিত্রনাট্য সাজিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের ফাঁদে পড়ে গিয়েছেন নিজেই!’’
রাহুলের বয়ান অনুযায়ী, ঘটনার সূত্রপাত রবিবার। সে দিন রাতে রিজেন্ট এস্টেটে রাহুলবাবুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হন শুভাশিস রায়চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি। পরিচয় দেন পুলিশের লোক বলে। রাহুলবাবু বাড়িতে না থাকায় তাঁকে সোমবার রাজ্য দফতরে আসতে বলেন রাহুলবাবুর আপ্তসহায়ক গোপাল জানা। রাহুলবাবু জানান, এ দিন ১২টার পর দলের দফতরে ঢোকেন তিনি। তার পরই ব্যক্তিগত, জরুরি কথা আছে বলায় ওই আগন্তুককে ঘরে আসতে বলা হয়। শুভাশিস তাঁর সঙ্গী আমিনুর রহমানকে নিয়ে রাহুলের ঘরে ঢোকেন। তাঁদের হাতে একটি কালো ব্যাগ ছিল।
আমিনুরকে দেখিয়ে শুভাশিস বলেন, ‘‘বেকারদের জন্য আপনি কিছু করুন।’’ রাহুলবাবু জানতে চান, ‘‘কী করতে পারি?’’ শুভাশিস বলেন, ‘‘কিছু জিনিস এ দিক থেকে ও দিক করতে সাহায্য করুন।’’ রাহুলের প্রশ্ন, ‘‘কী জিনিস?’’ শুভাশিস বলেন, ‘‘ এ পার থেকে বাংলাদেশে গরু পাঠাতে আপনি সহযোগিতা করুন। যত মোটা টাকা লাগে, আপনাকে দেব।’’
রাহুলবাবুর দাবি, এ কথা শুনেই তিনি রেগে গিয়ে শুভাশিসের কলার ধরে থাপ্পড় কষিয়ে দেন। তাঁর হাঁকডাকে দলের লোকজন ঘরে জড়ো হয়ে যায়। দলীয় কর্মীরা ওই দু’জনকে দফতরের মূল ফটকের কাছে নিয়ে যান। সেখানে সব সময় পুলিশকর্মীরা থাকেন। ওই দু’জনকে তাঁদের হাতে দিয়ে জোড়াসাঁকো থানায় ফোন করা হয়। পরে রাহুলবাবুরা জানতে পারেন, শুভাশিস স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইনস্পেক্টর এবং আমিনুর কনস্টেবল।
বিজেপির তরফে দাবি, জোড়াসাঁকো থানার পক্ষ থেকে প্রথমে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা রাজি হননি। তখন ওই মর্মেই লালবাজারে রিপোর্ট পাঠানো হয় থানা থেকে। নবান্নে দৌড়ে যান রাজীব কুমার। ফলে বিজেপি সাংবাদিক সম্মেলন করার আগেই প্রশাসনে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এই খবর। স্পেশাল ব্রাঞ্চের দুই কর্মী খামোখা এমন কাঁচা কাজ করতে যাবেন কেন, সেই জল্পনাতেই সরগরম হয়ে ওঠে গঙ্গার ও-পার।
রাজীব নিজে একটা ব্যাখ্যা অবশ্য দিয়েছেন নবান্নে। আমলা মহলের খবর, প্রাথমিক ভাবে তাঁর পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিজেপি কলকাতা পুলিশে ইউনিয়ন করতে চেষ্টা করছিল। বলা হয়েছিল, সীমান্তে পোস্টিং করিয়ে দেওয়া হবে। সে সব কারণে কেউ এমন কাণ্ড করতে পারে। সন্ধের মধ্যে অবশ্য এই বয়ান বদলে বলা হয়, পারিবারিক গরু পাচারের কারবারে সাহায্য চাইতেই ওই দু’জন রাহুলবাবুর কাছে গিয়েছিলেন। নবান্ন থেকে ফিরে অভিযুক্তদের সাসপেন্ড করেন রাজীব। তাঁর কাছে ঘটনার বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়েছে নবান্ন।
চূড়ান্ত রিপোর্ট সোমবার সন্ধে পর্যন্ত আসেনি। কিন্তু পুলিশ কর্মীরা নিজ দায়িত্বে গরু পাচারের জন্য রফা করতে গিয়েছেন— এমন দাবি শুনে প্রশাসনের কর্তারা কিন্তু বিস্মিত। তাঁদের বরং মনে পড়ছে, উপরমহলের নির্দেশ পেয়েই বহু বার নানা রকম ভূমিকায় নামতে হয়েছে পুলিশকে। ছত্রধর মাহাতোকে গ্রেফতার করতে কলকাতা পুলিশের দল সাংবাদিক সেজে জঙ্গলমহল গিয়েছিল। এক সময় বীরভূমের ডাকাতি ঠেকাতে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে বাসে লুকিয়ে থাকতেন পুলিশ অফিসাররা। এই সেদিনও কলকাতা বন্দরের চেয়ারম্যান রাজপাল সিংহ কাহালোঁকে জাল পেতেই গ্রেফতার করেছে কলকাতা পুলিশ। সব ক’টির পিছনেই ছিল রাজীব কুমারের মস্তিষ্ক।
মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত এই অফিসারের দিকে নজর রয়েছে নির্বাচন কমিশনেরও। এর আগে কমিশনের ফুল বেঞ্চ তাঁকে জরুরি তলব করেছিল। এ দিনের ঘটনার কথাও কমিশনের কানে গিয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে কমিশন সূত্রের খবর। তবে রাজীব নিজে এ দিন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চাননি। কমিশনারের অফিসে ফোন করা হলে জানানো হয় তিনি বৈঠকে আছেন। পরে ফোন বা এসএমএস করা হলে উত্তর দেননি।
রাহুল বলছেন, ‘‘শুভাশিসবাবুরা তো বলির পাঁঠা। কার নির্দেশে এবং কোন উদ্দেশ্যে তাঁরা এসেছিলেন, সেই রহস্য ভেদ করতে সিবিআই তদন্ত চাই।’’ শাসক দল এর পিছনে তাদের যোগ মানতে চায়নি। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ওঁদের কথায়, যা কিছু ঘটে, তৃণমূল করে। যা কিছু ভাল, ওরা করে।’’