জিতুজুড়ির জনসভায় নেত্রীর সঙ্গে মানবাজার কেন্দ্রের প্রার্থী সন্ধ্যারানি টুডু। —নিজস্ব চিত্র
পুরুলিয়ার ৯টি আসনই দখল করাই তৃণমূলের পাখির চোখ। সেই লক্ষ্যে এ বার এই জেলায় আটটি সভা করছেন দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত দু’দিন ধরে চপারে চেপে পুরুলিয়ায় কার্যত চরকি পাক খাচ্ছেন তৃণমূল নেত্রী। রবিবার তাঁর সভা ছিল বাঘমুণ্ডি, বলরামপুর এবং বরাবাজারে। এর মধ্যে বাঘমুণ্ডি ও বরাবাজার (বান্দোয়ান বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত) বিরোধীদের দখলে। সভা করে রবিবার বিকেলে রোড-শো করেন পুরুলিয়া শহরে। সোমবার মমতার প্রথম সভাই ছিল জঙ্গলমহলের আর এক জয়পুরে।
গত বিধানসভা নির্বাচনে সার্বিক জোট না হওয়ায় ফাঁকতালে জয়পুর আসনটি গিয়েছিল বামেদের দখলে। সে বার জোট ছিল কংগ্রেস-তৃণমূলের। এ বার ছবিটা আলাদা। কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বামফ্রন্ট। তাই বাঘমুণ্ডির মতোই বরাবর কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত জয়পুরেও দলীয় প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে চেষ্টার কসুর রাখছে না তৃণমূল। প্রত্যাশিত ভাবেই তাই এ দিন স্থানীয় বামনিয়া ময়দানে আয়োজিত ওই সভায় বাম-কংগ্রেস জোটকে তীব্র আক্রমণ করেছেন তৃণমূল নেত্রী। বললেন, ‘‘এখানে বিধায়ক ফরওয়ার্ড ব্লকের। সিপিএম-কংগ্রেস ভাই-ভাই হয়ে দীর্ঘদিন ধরে যৌথ ভাবে ক্ষমতা দখল করে রেখেছে। চিরকাল এরা এ ভাবেই ক্ষমতা দখল করে রাখে। এটা বুঝেই আমরা তৃণমূল গঠন করেছিলাম। আগে কংগ্রেস ছিল সিপিএমের বি-টিম। এখন এ-টিম হয়ে গেছে!’’
বস্তুত, গত এক দশক ধরে বামেদের দখলে থাকা জয়পুরে দলীয় প্রার্থীকে জিতিয়ে আনা যে শক্ত কাজ, সেটা কংগ্রেস-সিপিএমের সার্বিক জোট হওয়ার পরে ভালই বুঝছেন শাসকদলের নেতারা। এমনিতেই লোকসভা নির্বাচনের পরিসংখ্যানের নিরিখে জয়পুর বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের চেয়ে ৩৫ হাজারের কিছু বেশি ভোটে এগিয়ে রয়েছে সিপিএম-কংগ্রেস জোট। প্রথম দিকে এই কেন্দ্র নিয়ে কংগ্রেস ও সিপিএমের মধ্যে দড়ি টানাটানি চলছিল। জয়পুরে ফ্রন্টের তরফে ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করার পরেও এই কেন্দ্রে প্রার্থী দিতে বদ্ধপরিকর ছিল কংগ্রেস। এমনকী, প্রয়োজনে বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই হবে বলে ইঙ্গিত দিয়ছিল কংগ্রেস। তা দেখে মুখের হাসি চওড়া হয়েছিল তৃণমূল নেতাদের। কিন্তু শেষ অবধি বৃহত্তর স্বার্থে জটিলতা কেটেছে। কংগ্রেস এই আসন বামেদের জন্যই ছেড়েছে।
এর ফলে প্রমাদ গুনছে তৃণমূল। লোকসভার বিশাল ব্যবধান কমিয়ে জয়পুরে তৃণমূল প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার কাজে আবার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই অঞ্চলে দলের গোষ্ঠী কোন্দল। জয়পুরের ব্লক সভাপতি কীর্তন মাহাতোর বদলে কংগ্রেস থেকে আসা শক্তিপদ মাহাতোকে প্রার্থী করায় ব্লকের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী পুরুলিয়া শহরে প্রার্থী বদলের দাবিতে মিছিল করে দলীয় কার্যালয়ে বিক্ষোভ পর্যন্ত দেখিয়েছিল। দ্বন্দ্ব সামলাতে শেষ পর্যন্ত আসরে নামতে হয়েছে জেলা সভাপতি শান্তিরাম মাহাতোকে। কীর্তন-শক্তিপদকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে বিবাদ মেটানোর চেষ্টা করেছেন শান্তিরামবাবু। তবে দুই নেতার অনুগামীদের মধ্যে বিভেদ কতটা মিটেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে দলের অন্দরেই।
আর এই প্রেক্ষাপটেই জয়পুরে সভা করতে গিয়ে মমতা বারবার জোটকে বিঁধেছেন। কংগ্রেসের নিচুতলার কর্মীদের প্রতি তাঁর প্রশ্ন, ‘‘যারা প্রকৃত কংগ্রেস করেন, তাঁরা কী ভাবে সিপিএমের লাল উত্তরীয় গলায় ঝোলাবেন?’’ পাশাপাশি জয়পুরে তৃণমূল প্রার্থীকে জিতিয়ে এলাকার সার্বিক উন্নয়নের বিষয়ে সওয়াল করেন তৃণমূল নেত্রী। প্রসঙ্গত, জয়পুর বিধানসভার বেশির ভাগ পঞ্চায়েত বাম ও কংগ্রেসের দখলে। দু’টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে একটি তৃণমূলের দখলে। ওই প্রসঙ্গ তুলে মমতা বলেন, ‘‘জয়পুরে উন্নয়নের কাজ করতে একটা সমস্যা হচ্ছে। আপনারা আমাদের সমর্থন করুন। যেমন পুরুলিয়া, বলরামপুর, কাশীপুরে হয়েছে, তেমনিই জয়পুরকে সাজিয়ে দেব।”
এ দিন মমতার পরের সভা ছিল কাশীপুরের রঙ্গিলাডি গ্রামের মাঠে। জয়পুরে জোটের উদ্দেশে তোপ দাগলেও কাশীপুরে বিদায়ী তৃণমূল বিধায়ক স্বপন বেলথরিয়ার সঙ্গে আদিবাসী সম্প্রদায়ের একাংশের তৈরি হওয়া দূরত্ব ঘোচানোর প্রয়াস করেছেন। জয়পুরের মতো গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বা লোকসভার ফলের নিরিখে কাশীপুর নিয়ে কোনও সমস্যা না থাকলেও এই কেন্দ্রেই পাহাড় কেটে পাথর বের করার সরকারি প্রকল্পকে ঘিরে আদিবাসীদের একাংশের সঙ্গে শাসকদলের দূরত্ব তৈরি হওয়ার কথা বিলক্ষণ জানা ছিল তৃণমূল নেত্রীর। ওই সমস্যা মিটেছিল মমতার হস্তক্ষেপেই। এই কেন্দ্রে ৩০ শতাংশ আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভোট রয়েছে। দুই বিরোধী সিপিএম এবং বিজেপি আবার প্রার্থী করেছে আদিবাসী সম্প্রদায়ের দুই নেতাকে।
এই বিষয়গুলি মাথায় রেখেই এ দিন নিজের বক্তৃতায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের উদ্দেশে তৃণমূল নেত্রী বলেন, ‘‘আমরা আপনাদের করম থান, মারাং বুরু, গরাম থানকে অধিকার দিয়েছি। ওই এলাকাকে সংরক্ষিত করেছি।” তার পরেই স্বপনবাবুর নাম না নিয়েই মমতার আবেদন, ‘‘কেউ কোনও অন্যায় করে থাকলে বলবেন। আমি শাসন করে দেব। কিন্তু, সেই কারণে আমাদের ভুল বুঝে মুখ ফিরিয়ে নেবেন না। আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাবেন না।’’
পরের সভা ছিল মানবাজার থানার জিতুজুড়ি গ্রামের ফুটবল মাঠে। তিনটি সভাতেই তৃণমূল সরকারের পাঁচ বছরের উন্নয়নের ফিরিস্তি দেন মমতা। মানবাজারের তৃণমূল প্রার্থী সন্ধ্যারানি টুডুকে সামনে এনে তিনি বলেন, ‘‘মানবাজারে প্রচুর কাজ হয়েছে। সব বলে বোঝাতে পারব না। সন্ধ্যাকে আবার আপনারা জেতান। বাকি থাকা কাজ ওর হাত দিয়ে সব আমি করে দেব।’’
মমতার সভায় ফের উপচে পড়া ভিডের ছবি দেখে স্বস্তিও ফিরেছে শাসকশিবিরে। কাশীপুরের সভায় গত দু’দিনে সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়েছিল।